মুক্তিযুদ্ধ

ইতিহাসের খনি, মুক্তিযুদ্ধের বয়ান

সিদরাতুল মুনতাহা রাইসা

৭১-এর আকরগ্রন্থ l সালেক খোকন l কথাপ্রকাশ l ঢাকা, ২০২১ l ১৫০০ টাকা

৭১-এর আকরগ্রন্থ’’ – নামটি থেকেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অদ্ভুত ঘ্রাণ, যা একইসঙ্গে তিক্ত-মিঠা অনুভূতি জাগায় প্রাণে।

লেখক-গবেষক সালেক খোকনের এক দশকের এই অসামান্য ফসল ধারণ করে আছে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের ১১১ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সম্মুখ সমরের অবিস্মরণীয় স্মৃতি, যা তাঁদের হৃৎপিণ্ডকে জড়িয়ে আছে জালের মতো শিরা-উপশিরা রূপে। ৪৬৫টি আলোকচিত্র যেন মুক্তিযোদ্ধাদের ফুসফুসের একেকটি খণ্ড। ফুসফুস যেমন প্রতি মুহূর্তের নিশ্বাস-প্রশ্বাসে আমাদের জানিয়ে দেয় আমরা বেঁচে আছি, তেমনি এই প্রামাণ্য দলিলগুলোও প্রতিনিয়ত জানান দেয় ১৯৭১-এর সেই দুর্দমনীয় অকুতোভয়, একই সঙ্গে ভয়াল ও কষ্টের স্মৃতিমালা, রক্তাক্ত মাতৃভূমির কথা।

শুধু নিঃস্বার্থ বীর যোদ্ধা নয়, স্বার্থত্যাগী আপামর বাঙালি, অগণিত বীরাঙ্গনা, রাঙা হয়ে ওঠে বাংলার মাটি, লক্ষ বীরের রক্তের গন্ধে ভরা বাতাস – সকলের জীবনীর এক সমাবেশ এই গ্রন্থ।

মোট ১১১ জন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা অকপটে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে, নিজেদের ভাষায় ব্যক্ত করেছেন তাঁদের মনের গভীরে স্থান করে নেওয়া যুদ্ধদিনের সেই রোমাঞ্চকর বেদনামিশ্রিত সময়ের কথা। সেই আখ্যান বারংবার স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘এত যন্ত্রণা নিয়েও মানুষ বাঁচতে পারে!’ ‘এতটা ত্যাগ মানুষ করতে পারে!’

একাত্তরের বীর সেনানীদের কথায় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে দেশ, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, নবীন প্রজন্ম নিয়ে সন্তুষ্টি, কখনোবা আক্ষেপ। তবে তাঁদের প্রত্যেকেরই আকাশচুম্বী প্রত্যাশা ধারণ করে রেখেছে এ-গ্রন্থ। এ যেন শুধু যুদ্ধদিনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করে না, বলে সত্যিকার মানুষ হওয়ার কথা।

অক্ষরজ্ঞানহীন কিষান থেকে শুরু করে সম্ভ্রান্ত উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত মানুষ পর্যন্ত নিজের দেশের মাটিকে স্বাধীন করতে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তা এই অসামান্য গ্রন্থটি পাঠ ব্যতীত অনুধাবন করা দুষ্কর বলেই প্রতীয়মান হয়, বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের কাছে, যাদের জন্ম ’৭১-এর অনেক পরে।

গ্রন্থটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে লেখক প্রকাশ করেছেন দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি সেই বীর সেনানীদের অপত্য ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিরোধ, তাঁদের যন্ত্রণা, বীরত্ব, পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি তাঁদের আশাবাদ – এমন নানা অনুষঙ্গ। সেসব বর্ণনা যেমন জীবন্ত, তেমনি প্রেরণাদায়ী, যা যে-কোনো বয়সী পাঠকের মনে উন্মেষ ঘটাবে দেশ ও মানুষের প্রতি প্রদীপ্ত অঙ্গীকার।

৭১-এর আকরগ্রন্থ শুধু মুক্তিযুদ্ধের শেকড়ের সন্ধানই দেয় না, উপরন্তু আমাদের প্রত্যেকের ভেতর বাঙালিত্বের যে শেকড় আজন্মকাল ধরে রোপিত, তা উপলব্ধি করতে শেখায়। তাই আমার মতে, সবার জন্য তো বটেই, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের জন্য, এটি অবশ্যপাঠ্য।

বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠের প্রতি শিক্ষার্থীদের উদাসীনতার জন্য, আমার মতে, দায়ী বর্তমান স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ের ধরাবাঁধা ‘ইতিহাস’। বইয়ের ‘ইতিহাস অধ্যায়’ তা বলে না যা মুক্তিযোদ্ধাদের বয়ানে উঠে এসেছে এ-গ্রন্থে। প্রাঞ্জল ভাষা গ্রন্থটিকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছে।

পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭১-এ এদেশের আপামর জনসাধারণ, বিশেষ করে সম্মুখ সমরের যোদ্ধাদের, অশ্রুত নানা ঘটনাপঞ্জি ’৭১-এর আকরগ্রন্থ, যা পাঠ করলে নিজেদের স্বরূপ চিনতে ও বুঝতে আমাদের বেগ পেতে হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। একই সঙ্গে মাতৃভূমির প্রতি আমাদের দায়কে অন্তরে ধারণ করার তাগিদ দেয় এ-গ্রন্থ।

[গ্রন্থ-সমালোচক দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী, ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যয়নরত]

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম-এ, প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button