পাহাড়ীদের নাগরপুর অপারেশন
এক মুক্তিযোদ্ধার নাম বদলে গেছে একাত্তরে। ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব পেয়েছেন তিনি। ভীষণ সাহসী। মৃত্যুর আশঙ্কা জেনেও যুদ্ধে এগিয়ে যেতেন; জীবনের মায়া তার ছিল না। একরোখা ও বেপরোয়া যোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন টাঙ্গাইল অঞ্চলে। এমন আচরণের ব্যক্তিকে ওখানকার লোকেরা বলে ‘পাহাইড়া’। সহযোদ্ধাদের এই ডাক একসময় রূপ নেয় ‘পাহাড়ী’তে। ‘এস এম আনোয়ার হোসেন’ থেকে এভাবেই তিনি হয়ে যান ‘আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী’। এমন তথ্য দেন তারই এক সহযোদ্ধা। ঠিকানা দিয়ে সহযোগিতাও করেন। অতঃপর এক বিকেলে আলাপ চলে তার সঙ্গে।
রমজান আলী শেখ ও খাইরুন নেছার একমাত্র সন্তান আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী। বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার দিয়ার ধানগড়া গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন সিরাজগঞ্জ কলেজের ডিগ্রি থার্ড ইয়ারের ছাত্র। ১২ মার্চ থেকেই ট্রেনিং শুরু করেন সিরাজগঞ্জ কলেজ মাঠে। স্কাউটসের ডামি রাইফেল দিয়ে তেত্রিশজনকে ট্রেনিং করান সেনাবাহিনীর ল্যান্স নায়েক লুৎফর রহমান অরুণ ও রবিউল গেরিলা। ২৫ মার্চের পর থেকেই সিরাজগঞ্জ শহর থমথমে। প্লেন যাওয়ার শব্দ পেলেই মনে করা হতো বোমা ফেলা হবে। এ কারণে প্রায় রাতেই গোটা শহর ‘ব্ল্যাক আউট’ করে রাখা হতো। একবার খবর আসে পাকিস্তানি সেনারা আরিচা-নগরবাড়ী হয়ে সিরাজগঞ্জে ঢুকবে। তাদের ঠেকাতে তখন প্রস্তুতি নেন তারা।
কীভাবে? তার ভাষায়, “৮ এপ্রিল ১৯৭১। প্রতিরোধের জন্য সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী ঘাটে আমরা পজিশন নিই। নেতৃত্বে ছিলেন লতিফ মির্জা। এরই মধ্যে থানা থেকে সংগ্রহ করা হয় আটটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল। আমাদের সঙ্গে যোগ দেন বগুড়া থেকে আসা পাঁচজন বাঙালি ইপিআর সদস্য। তাদের কাছে ছিল চায়নিজ এলএমজি, এসএমজি ও রাইফেল। নদীর পাড়ে বাংকার তৈরি করে অপেক্ষা করতে থাকি। সেসময় ইপিআর সদস্যরা আমাদের এলএমজি ও এসএমজি চালানো শিখিয়ে দেন। ২৩ এপ্রিল সকালবেলা। পাকিস্তানি সেনারা দুটি জিপে এসে নদীর ওপারে আমাদের ঠিক উল্টো দিকে পজিশন নেয়। ফায়ার ওপেন করে। ফায়ার করে পাল্টা জবাব দিই। তুমুল গুলিবর্ষণ চলছে। আমাদের কাছে ওয়ার্কশপে তৈরি লোকাল একটি অস্ত্র ছিল। সেটি দিয়ে গোলা নিক্ষেপের সময় বিকট শব্দ হতো। পাকিস্তানি সেনারা ভাবল ওটা ভারী কোনো অস্ত্র। মিনিট বিশেক গোলাগুলির পরই তারা পিছু হটে। আমরা তখন ‘জয় বাংলা’ সেøাগান তুলি। একাত্তরে আনন্দ ও বীরত্ব প্রকাশের ভাষা ছিল জয় বাংলা।”
কিন্তু আধুনিক সামরিক অস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের ঠেকাতে পারেন না পাহাড়ীরা। ফলে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সেনারা সিরাজগঞ্জ শহর দখলে নিয়ে বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। পাহাড়ী তখন পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে আশ্রয় নেন পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধুলাউড়ি গ্রামে। সেখানেও চলছিল নির্মম হত্যাযজ্ঞ।
তখন কী করলেন? পাহাড়ী বলেন, “মে মাসের শেষ দিককার কথা। বন্ধু আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে চলে যাই তার নানাবাড়ি, টাঙ্গাইলের গোপালপুরে। সেখানেই যোগ দিই কাদেরিয়া বাহিনীর হুমায়ুন (পাকিস্তানিদের ভাষায় হনুমান) কোম্পানিতে। পরে ওই কোম্পানিরই টুআইসির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এগার নম্বর সেক্টরে হাজরাবাড়ির চেরাভাঙ্গা ব্রিজ, ভেংগুলা, ভুয়াপুর থানা, সিংগুরিয়া, সোহাগপাড়া ব্রিজ, মির্জাপুর থানা, নাগরপুরসহ মোট একুশটি অপরেশন করি।”
এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশের গুলি তার বাম গালের মাংস ভেদ করে চোয়ালের হাড় ভেঙে বেরিয়ে যায়। মৃত্যুপথ থেকে ফিরে আসেন তিনি। আয়নার সামনে দাঁড়ালে আজও সেই ক্ষত মনে করিয়ে দেয় রক্তাক্ত ওই দিনটিকে। তিনি বলেন, “পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল নাগরপুর থানায়। তালগাছ কেটে তারা থানার চারপাশে দুর্ভেদ্য বাংকার তৈরি করে রাখে। দিনেদুপুরে সেটি দখলে নিতে হবে। কাদেরিয়া বাহিনীর আক্রমণের ধরন ছিল ফেস-টু-ফেস যুদ্ধ। আমরা ছিলাম নাগরপুরের লাউহাঠি গ্রামের এক স্কুলে। দশটা কোম্পানির প্রায় এক হাজার যোদ্ধা। প্রথম ব্রিফিং দিয়ে বলে দেওয়া হয় কোন কোম্পানি কোন দিক থেকে আক্রমণ করবে। কথা ছিল তিন দিক থেকে আক্রমণের। পশ্চিম দিকটা থাকবে খোলা। সে পথে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে চাইলে আমাদের কোম্পানি তাদের জীবিত ধরবে। পরিকল্পনা মোতাবেক ৩০ নভেম্বর সকালে আমরা পজিশন নিলাম। অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী। দুটি থ্রি ইঞ্চ মর্টার নিক্ষেপের মাধ্যমে তিনি অপারেশন শুরু করেন। গোলাগুলি চলছে। কিন্তু আমরা ওঁৎ পেতে বসে আছি। অসাবধানতাবশত হঠাৎ সহযোদ্ধা নান্নুর এলএমজি থেকে মিস ফায়ার হয়। ফলে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের পজিশন টের পেয়ে যায়। ওরা বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। সহযোদ্ধারাও পালটা জবাব দেন।”
তিনি বলে চলেন, “বিকেল তখন তিনটা। আরেকটি দল নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিলেন কমান্ডার সবুর খান। তিনি আমার কাছে চিরকুট পাঠালেন, যাতে গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল নিয়ে শত্রুর বাংকার ভাঙতে তাকে সহযোগিতা করি। আমি দ্রুত হুমায়ুন বাঙালকে সঙ্গে নিয়ে সবুর খানের দিকে সরে আসি। পজিশন নিই নাগরপুর থানার সম্মুখে লৌহজং নদীর এপারে। পাকিস্তানি সেনারা খুব কাছাকাছি। দেখলাম একটি বাংকার থেকে চায়নিজ এলএমজির গুলি ছুড়ছে তারা। বাংকারটা টার্গেট করি। একটি জিগা গাছের পাশ থেকে জিরো অ্যাঙ্গেলে ফায়ার করতেই গ্রেনেড গিয়ে পড়ে বাংকারটির ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়ে সেখানে থাকা পাকিস্তানি সেনারা। তা দেখে আমরা উদ্দীপ্ত হই। টার্গেট করি আরেকটি বাংকার। সবুর খান অন্যদিকে ফায়ার দিচ্ছিলেন। হুমায়ুন বাঙাল গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেলটির বাঁট ধরে রেখেছেন। আমি হাঁটু গেড়ে পজিশনে বসা। ট্রিগারে চাপ দেব অমনি আমার দিকে চোখ পড়ে ওই বাংকারের এলএমজিম্যানের। দ্রুত সে ব্রাশের ব্যারেলটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দেয়। অমনি শত শত গুলি। একটি গুলি আমার বাঁ গাল ভেদ করে চোয়ালের হাড় ভেঙে বেরিয়ে যায়। পেছনে ছিটকে পড়ি। মনে হলো, চোখের সামনে হাজার হাজার জোনাকি পোকার আলো যেন জ¦লছে। এরপরই জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমার মাথাটা সবুর খানের কোলে। চোয়ালের হাড় রক্তাক্ত। মুখের দাঁত বেরিয়ে গেছে। গরম রক্ত পড়ছে। অনুভব করলাম, গলার ভেতর রক্ত গিয়ে গলগল শব্দ হচ্ছে। শুনলাম কে যেন বলছে, ‘পাহাড়ী মরে গেছে।’ বহু কষ্টে চোখ মেলে শুধু বললাম মরি নাই।”
চিকিৎসা নিলেন কোথায়?
‘সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে প্রথমে নেয় লাউহাটি স্কুল মাঠে, পরে ব্যারিস্টার শওকত আলীর কাছারিবাড়িতে। ওখানেই কাদেরিয়া বাহিনীর ডাক্তার শাহজাদা মুখে ও গলায় সেলাই করেন। একপর্যায়ে মুখে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। কী যে কষ্ট পেতাম তখন! নিজের শরীরের গন্ধ নিজের কাছেই অসহ্য লাগত! পরে কুমুদিনী হাসাপাতালে নরওয়ের ডাক্তাররা আমার মুখে ও গলায় চারবার অপারেশন করে সুস্থ করে তোলেন।’
প্রজন্ম অনেক মেধাবী। সারা পৃথিবীতে তারাই দেশের মুখ উজ্জ¦ল করবে এমনটাই বিশ্বাস বীরপ্রতীক আনোয়ার হোসেন পাহাড়ীর। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বললেন, “তোমরা এ দেশটাকে ভালোবেসো। দেশের স্বার্থে এক থেকো। সবাই মিলে জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতাকে রুখে দিয়ো। বিশ্বাস রেখো জয় বাংলার এ দেশে, জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতাও যাবে ভেসে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৭ এপ্রিল ২০২২
© 2022, https:.