বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিবাদটা ছিল আরেক যুদ্ধ
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক (বীরপ্রতীক)
“ছাত্রলীগে আমি যুক্ত হই ক্লাস এইটে থাকতেই। রাজনৈতিক ক্লাস হতো তখন। পরে কলেজে গিয়ে পুরোপুরি ছাত্রলীগের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বৈষম্যের কথাগুলো নেতাদের মুখে শুনতাম। কেন্দ্র থেকে আসত লিফলেট, পত্রিকা থেকেও জেনেছি নানা খবর। সেগুলো তুলে ধরে ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতাম আমরা।
টাঙ্গাইলকে বলা হতো রাজনীতির সূতিকাগার। জেলা ছাত্রলীগ তখন ছিল দুইভাগে বিভক্ত। এক ভাগের সভাপতি আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম আর সেক্রেটারি ছিলেন আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। আরেক ভাগে আলমগীর খান মিনু সভাপতি আর খন্দকার আব্দুল বাতেন সেক্রেটারি। কাদের সিদ্দিকীর গ্রুপে ছিলাম আমরা। শহর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলাম, খন্দকার আনোয়ার হোসেন ছিলেন সভাপতি। মিনু ও বাতেন গ্রুপটিকে শাজাহান সিরাজ আর আমাদের গ্রুপটিকে লিড করতেন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী।
ওই সময় টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন আব্দুল মান্নান, শামসুর রহমান খান শাহজাহান, মির্জা তোফাজ্জেল হোসেন মুকুল, বদিউজ্জামান খান, ফজলুর রহমান খান ফারুক প্রমুখ। শহরের নিরালা মোড় থেকে মিছিল নিয়ে আমরা শহীদ মিনারে গিয়ে মিটিং করতাম। ন্যাপও তখন শক্তিশালী। তবে তাদের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ ছিল না। রাজনীতির মঞ্চে নানা বক্তব্য দেওয়া হতো। কিন্তু তাতে ব্যক্তি আক্রোশ তৈরি হতো না। সন্ধ্যার পর দুই দলের নেতারাই ক্ষিতিশ বাবুর স্টলে বসে একসঙ্গে চা খেত। মাঠের বক্তব্য তখন মাঠেই থাকত। এখন সেটা চিন্তাও করা যায় না। তখন কাজ করে যারা এগিয়ে থাকত তারাই নেতা হতো। এখন যারা নেতাদের তোষাতে পারে তারাই সুবিধা পায়। নেতাদের মন সন্তষ্ট করেই নেতা হওয়া যায়।”
টাঙ্গাইলে একাত্তর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অবস্থার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক (বীরপ্রতীক)। বীরপ্রতীক ফজলু নামে তিনি অধিক পরিচিত। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা প্রসঙ্গে।
ওসমান গণি ও লাইলী বেগমের দ্বিতীয় সন্তান ফজলুল হক। বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার উপলদিয়া গ্রামে। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, থানা শিক্ষা অফিসার ছিলেন। পরিবারসহ থাকতেন টাঙ্গাইল শহরে, প্যারাডাইজ পাড়ায়। ফজলুর লেখাপড়ায় হাতিখড়ি পিটিআই প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৬৯ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন বিবেকানন্দ হাই স্কুল থেকে। এরপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন করোটিয়া সা’দত কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।
আন্দোলন-সংগ্রামের কথা উঠতেই তিনি তুলে ধরেন ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রসঙ্গ। বলেন, “নেতাদের সঙ্গে ওইদিন সকালে আমরাও যাই সেখানে। সবার হাতে হাতে ছিল লাঠি। ছাত্ররাজনীতি যারা করতাম তারা ধরেই নিয়েছিলাম পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ হবে। মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ শুনতেই যাই রেসকোর্সে। তার ভাষণের প্রতিটি কথাই প্রবলভাবে নাড়া দেয়। ওটা ছিল জাদুকরি ভাষণ। ওই ভাষণই সারাদেশের কৃষক, জেলে, কামার, কুমার ও ছাত্র-জনতাকে স্বাধীনতার জন্য জাগ্রত করে তোলে।
বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে শেষে বললেন– ‘এবারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ আমাদের কাছে ওটাই ছিল স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা। ফলে যুদ্ধের জন্য আমরা প্রস্তুতি নিতে থাকি। টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাগমারী কলেজ মাঠে ট্রেনিংয়ের আয়োজন করা হয়। সেখানে ট্রেনিং করি ১৫ থেকে ২০ জনের মতো। ট্রেইনার ছিলেন জয়নাল আবেদীন। ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের ডামি রাইফেল দিয়ে চলে ট্রেনিং।”
২৫শে মার্চ ১৯৭১। সারাদেশে শুরু হয় গণহত্যা। পরিবারসহ ফজলুরা তখন চলে যান গ্রামের বাড়ি, ঘটাইলে। ওখানে ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকেন। এক নাপিত বাড়ি ছিল। যাত্রা, সঙ, নাটক সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলত ওই বাড়িতে। ছাত্রলীগের সবাই প্রতিদিন ভোরবেলা ওই বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিতো। ওখানেই সিদ্ধান্ত হয় টাঙ্গাইলে কী হচ্ছে শহরে গিয়ে সেই খবর জেনে আসার। ছাত্র ইউনিয়ন করত ভোলা। তার সঙ্গেই পায়ে হেঁটে টাঙ্গাইল যান ফজলু।
বাকি ঘটনা শুনি তার জবানিতে। তার ভাষায়– “দেখি, কাদের সিদ্দিকী জিপ নিয়ে কুমুদীনি কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেখেই গাড়ি থামিয়ে বলেন, যাবি? রাজি হতেই তুলে নিলো। ওটাই ছিল যুদ্ধযাত্রা। আমরা ঘারিন্দা গেলাম। সেখানে দেখি একটা ট্রাকভর্তি অস্ত্র ও কিছু খাদ্য সামগ্রী। ওটা নিয়ে এলেঙ্গা দিয়ে বাংড়া হয়ে চলে যাই কাদের সিদ্দিকীর বাড়িতে, ছাতিহাটি গ্রামে। ওখান থেকে অস্ত্রগুলো নিয়ে আস্তে আস্তে পাহাড়ের দিকে অর্থাৎ বড়চওনার ইদ্রিসের বাড়িতে চলে যাই। সেখানে খবর পাই এক নন বেঙ্গলি এডিসি লুকিয়ে আছেন আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়িতে। আমি, কাদের সিদ্দিকী ও সবুর খান বীরবিক্রম গিয়ে ওই এডিসিকে গ্রেফতার করে পাহাড়ে নিয়ে রাখি। সেখানেও ট্রেনিং করি। অস্ত্রটাও ভালভাবে চালানো শিখে নিই।”
তিনি আরও বলেন, “মে মাসের শেষ বা জুনের প্রথম দিকে অংশ নিই বল্লার যুদ্ধে। কাদের সিদ্দিকীর একটা স্পেশাল গ্রুপ ছিল। যার কমান্ডার ছিলেন সবুর খান। তাকে আলাদা কোম্পানি তৈরি করে দিলে আমাকে ওই স্পেশাল গ্রুপের কমান্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গ্রুপটিতে ছিল ত্রিশ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা। কাদের সিদ্দিকী নিজেও থাকতেন। প্রত্যেকের কাছে অটো রাইফেল। আমরা যুদ্ধ করি বাসাইল, কামুটিয়া, রথখোলা, করোটিয়া, মটরা, এলাসিন, সিলিমপুর, ভাতখোয়া, নারিন্দা, নাগরপুর, পালিমা, বল্লা, বাউসি, ভুয়াপুর (ভূঞাপুর)সহ টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায়। কাদেরিয়া বাহিনীর যুদ্ধগুলো হতো দিনের বেলায়, ফ্রন্ট টু ফ্রন্ট।”
কাদেরিয়া বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল নাগরপুর থানা অপারেশন। টাঙ্গাইলে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে ওই যুদ্ধে। প্রায় এক হাজার মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেয় ওই অপারেশনে। কিন্তু তবুও প্রথমদিকে বিজয় আসেনি। মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর ভাষায়, “কাদেরিয়া বাহিনীর সাতটি কোম্পানিকে এক করে তিনটি কোম্পানিতে ভাগ করা হয়। একটা কোম্পানির দায়িত্ব থাকে সবুর খান বীরবীক্রম, আরেকটির দায়িত্বে গোলাম মোস্তফা, অন্য কোম্পানিটির দায়িত্বে থাকি আমি নিজে। পরিকল্পনা হয় সবুর খান থাকবেন থানার দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে, গোলাম মোস্তফা থানার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে, ফ্রন্টে আমি আর হুমায়ুন বাঙালরা (কোম্পানি কমান্ডার কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙাল) উত্তর-পূর্ব পাশে। তবে নাগপুর থানায় উঠে দখলে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর।
৩০ নভেম্বর ১৯৭১। সকালের দিকে পজিশনে চলে যাই। প্রথম ফায়ার ওপেন করবেন কাদের সিদ্দিকী। ওনার অবস্থান ছিল পূর্ব-দক্ষিণে, একটু দূরে যেন মর্টার মারা যায়। উনি থ্রি ইঞ্চ মর্টার মারলে সবগুলো গ্রুপই ফায়ার ওপেন করে। ত্রিমুখী আক্রমণ করি। শুধু ওদের পেছন সাইডটা খোলা ছিল।
তুমুল গোলাগুলি চলছে। কিন্তু আমার গ্রুপটি ফায়ার করতে পারে না। কেন? সমতল ভূমি। ফায়ারের পজিশন নেওয়ার কোনো জায়গায়ও নাই। ওরা থানার ওপর বাঙ্কারে। এগোলে নির্ঘাত মৃত্যু। একটা খাল পার হয়ে জমিতে গিয়ে উঠি। খেতের সামান্য উঁচু আইলই আমাদের ডিফেন্স। মাথা উঁচু করলেই শেষ। ফলে কোনোভাবেই ফায়ার করা সম্ভব হয় না। গোলাগুলি চলছে। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম ডান পাশে শামসু ‘মা রে’ বলে চিৎকার দিছে। দেখলাম ওর শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছে। মুক্তাগাছার ছেলে মকবুল শামসুকে কাঁধে নিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু খালের কাছে যেতেই সেও ছিটিকে পড়ে। প্রচণ্ড ফায়ার হচ্ছিল। বাম পাশে আরেকজন সহযোদ্ধাও রক্তাক্ত হয়। তাকে নিয়ে পেছনে সরে যায় কালাম। সহযোদ্ধাদের আহত হওয়া আমাদের ভেতরটাকে খামচে ধরে। প্রাণপনে লড়ছি। সন্ধ্যা হয় হয়। পাকিস্তানি আর্মি এগিয়ে আসলেই আমাদের হাতেনাতে ধরতে পারে। কিন্তু দুদিকের ফায়ারিংয়ের কারণেই ওরা এগোতে পারে না। ওইদিনই এক গুলিতে রক্তাক্ত হয় হুমায়ুন বাঙাল আর আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী। কিন্তু নাগরপুর থানা দখল করতে পারি না। কারণ পাকিস্তানি আর্মি মোটামুটি ডিফেন্স ছেড়ে দিয়ে পেছন চলে যেতে থাকে। ওইদিকটাতে তারা হুমায়ুন বাঙালের গ্রুপের বাঁধার মুখে পড়ে। ফলে আবার থানায় এসে পজিশন নেয়। তাদের তুমুল ফায়ারের কারণে থানায় উঠতে পারি না।”
এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের শেলের স্প্রিন্টারে রক্তাক্ত হন বীরপ্রতীক ফজলুল হক। কীভাবে?
তিনি বলেন, “আমরা তখন নারিন্দাতে। সন্ধ্যায় দেখি পশ্চিমে প্রচণ্ড আগুন জ্বলছে আর গুলির শব্দ হচ্ছে। পরে খবর পাই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি জাহাজ পারছে (আটকে রেখেছে)। ভুয়াপুর (ভূঞাপুর) হয়ে চলে যাই মাটিকাটায়। পৌঁছাই খুব সকালে। ওখানে ছিলেন কোম্পানি কমান্ডার হাবিবুর রহমান। আগেই মুক্তিযোদ্ধারা আগুন দিয়ে জাহাজ জ্বালিয়ে দেয়।
১৩ আগস্ট ১৯৭১। হাবিবুর রহমানের গ্রুপের সঙ্গে আমরা একটা বাঁধের পাশে নদীর তীরে অবস্থান নিই। দুপুরের দিকে সিরাজগঞ্জ থেকে লঞ্চে এসে পাকিস্তানি সেনারা ফায়ার শুরু করে। শুরু হয় গোলাগুলি। আমরা একটা গুলি করলে ওরা করে শত শত। এর মধ্যেই ওরা থ্রিইঞ্চ মর্টার ছুড়তে থাকে। ডানে ও বাঁয়ে শেল এসে পড়তে থাকে। হাবিব সাহেব চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘ফজলু তুই সরে পড়। ওগো ওপিতে ধরা পড়ছোছ তুই।’
শুনে আমি গড়িয়ে দ্রুত সরে পড়ি। শেল পড়েই বার্স্ট হয়। সরতে না পারলে হয়তো মরতে হতো। তবে জীবন না গেলেও শেলের অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত হয় বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ। জখম খুব গুরুতর ছিল না। স্প্লিন্টারগুলো সহজেই বের করে ফেলি। পাশেই ছিলেন আব্দুর রহমান। মর্টারের বিস্ফোরণের শব্দে তার কানের পাতাও ফেটে রক্ত বেরুতে থাকে।
১৪ অগাস্ট ওরা এয়ার শেলিং শুরু করে। পশ্চিমমুখো হয়ে পজিশনে ছিলাম। এয়ার শেলিং থেকে বাঁচার পদ্ধতি জানা ছিল না। আমরা তখন একেক দিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। সঙ্গে ছিল রংপুর সারিয়াকান্দির রেজাউল নামে এক ছেলে। সে পড়ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এয়ারটা ফলো করে আমরা বালির ভেতর গর্ত করে ঢুকে যাই। বিমান একটু দূরে যেতেই দৌড়ে আবার সরে পড়ি। এরপর ভূয়াপুর থেকে আমরা আবার পাহাড়ের দিকে চলে যাই। একাত্তরের গোটা অগাস্ট মাসটা ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর জন্য ভয়াবহ মাস। কেননা ওই মাসেই চর্তুদিক থেকে পাকিস্তানি আর্মিদের আক্রমণ প্রতিহত করতে হয়েছে।”
যে দেশের জন্য একাত্তরে রক্ত দিলেন, সেই দেশ কি পেয়েছেন?
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হকের অকপট উত্তর, “স্বাধীনতা ও স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু স্বপ্নের দেশ হয়নি। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নটা দেখিয়েছিল সেই স্বপ্নটাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন। মানুষ শান্তিতে থাকবে, ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা হবে। দুর্নীতির উর্ধ্বে থাকবে দেশ। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন তো বাস্তবায়ন হয় নাই। তাই আমাদের স্বপ্নটা এখনও স্বপ্নই রয়ে গেছে।”
আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, “এত বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের একটা নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা যায়নি। সরকারের সিদ্ধান্ত আছে বড় বড় রাস্তাগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করার। কিন্তু সেটা তো কোনও উপজেলায় কার্যকর হতে দেখি না। কেন হচ্ছে না? আমি মনে করি কারণটা রাজনৈতিক। আজকে রাস্তার নাম যদি মুক্তিযোদ্ধার নামে করা হয় তাহলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কদর থাকে না। এই মারপ্যাচেই সরকারের সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত হচ্ছে সারাদেশে। এই সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান বাড়িয়েছে। তাই সকল বিষয়ে এ সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশাও বেশি।”
১৫ই অগাস্ট ১৯৭৫। সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। ঘৃণ্য এই হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেনি বীরপ্রতীক ফজলুসহ কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধারা। তারা প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের প্রস্তুতি নেয়। সেটি করতে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে গ্রেফতার হন এই বীরপ্রতীক। তার ওপর চলে নির্মম অত্যাচার। চোখের কোনে অশ্রু জমিয়ে সে ইতিহাসের কথাই বলেন এই বীর যোদ্ধা।
“বঙ্গবন্ধু আমাদের অন্তরের মানুষ ছিলেন। তাই তার হত্যাটাতে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি নাই। চেয়েছিলাম অস্ত্র হাতে প্রতিশোধ নিয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে। কিন্তু সেটি যে খুব কঠিন কাজ ছিল তা বুঝতে পারিনি। আমি, জাহাঙ্গীর হোসেন তালুকদার ও হায়দার সিকদার– এই তিনজন বর্ডার পার হয়ে চলে যাই ভারতে, মাহেন্দ্রগঞ্জে। সেখানে গিয়ে পাই আশরাফ গিরাণী, আব্দুল্লাহ বীরপ্রতীক, দুলালসহ অনেককে। কাদের সিদ্দিকী আমাদের সশস্ত্র প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন। কয়েকদিন ট্রেনিংয়ের পর গোপনে আমরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ঢুকি বাংলাদেশে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ মাটির নিচে লুকিয়ে রাখি ভুয়াপুরের নলিন নামক জায়গায়। পরে চলে আসি ঘাটাইলে, গ্রামের বাড়িতে। আমাদের সশস্ত্র প্রতিবাদের খবরটি জানাজানি হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে তুলে নিয়ে যায়। কিছুদিন টাঙ্গাইল রাখার পর পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। প্রতিদিন সকাল বিকেল চলত আর্মিদের নিদারুন টর্চার। সেই টর্চারের কষ্টের কথা ঠিক বোঝাতে পারব না ভাই। তিনটি প্রশ্ন করা হতো তখন– অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোথায়, কারা সঙ্গে আছে, কাদের সিদ্দিকী কোথায়? মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। সেই স্বাধীন দেশের আর্মির টর্চারও সহ্য করেছি। কিন্তু তবুও মুখ খুলিনি। বঙ্গবন্ধুর জন্য ওটাই ছিল আরেক যুদ্ধ। পরে আমাকে তিন বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়। ফলে মানসিক ও শারীরিকভাবেও প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়ি।”
আপনারা সফল না হওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?
“কিছু পরিকল্পনায় ভুল ও নিজেদের মধ্যে অনৈক্য ছিল। ভেবেছিলাম নেতাদের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন ও সহযোগিতা পাবো। কিন্তু সেটা আমরা পাইনি। ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনও একটা বড় কারণ ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমার মতো অনেকে টর্চার ও সাজা ভোগ করেছে, ১০৪ জন মারাও গেছেন। কিন্তু এই ইতিহাসের স্বীকৃতি এখনও দেওয়া হয়নি। তবে এ নিয়ে আফসোস নেই কোনও। বরং আমি গর্বিত। জাতির জনকের হত্যার প্রতিবাদটুকু অন্তত করতে পেরেছি।”
কাদের সিদ্দিকীর মূল্যায়ন করতে গিয়ে বীরপ্রতীক ফজলুল হক অকপটে বলেন, “একাত্তরের কাদের সিদ্দিকী আমার কাছে দেবতা, মুক্তিযুদ্ধের দেবতা। পঁচাত্তরের কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী। একমাত্র আমরাই তার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিলাম। রাজনৈতিক মারপ্যাচে উনি এখন অন্য দল করছেন। তার সকল কাজে একমত না হলেও আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর দলই তার আদর্শ জায়গা। তার প্রতি সম্মান রেখেই আহবান জানাব বঙ্গবন্ধুর আদর্শেকে মনে রেখে তিনি যেন তার আগের জায়গায় ফিরে আসেন।”
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ জাতীয় সংগীতের এই লাইনটি যখন শোনেন তখন আনন্দে চোখে জল আসে বীরপ্রতীক ফজলুল হকের। স্বাধীন দেশে নিরীহ মানুষকে অত্যাচারিত হতে দেখলে তার বুকের ভেতরটা দুমড়ে ওঠে, কষ্ট পান তিনি। তবে দেশ নিয়ে তরুণদের আগ্রহ ও তাদের ভাবনাগুলো তাকে স্বপ্নবিভোর ও আশাবাদী করে তোলে। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বললেন, “বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, স্বাধীনতা এনেছি। তোমরাও সে আদর্শটি জেনে নিও। একাত্তরের বীরত্বের ইতিহাসই তোমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। তোমরা সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশটাকে গড়ে তোলো। মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়া ছায়ার মতো তোমাদের মাথার ওপর থাকবে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজে টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৫ মে ২০২২
© 2022, https:.