আর কত মৃত্যু হলে হুঁশ ফিরবে
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের ঘটনায় সারা দেশ শোকাহত। বিএম কন্টেইনার ডিপোর আগুন ও বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বেই বলে মনে করছে সবাই। পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে আগুনে ঝলসানো মানুষের স্বজনদের আহাজারি। পোড়া মানুষের চিৎকারে ভারী হয়ে উঠছে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটগুলো। খেটে খাওয়া শ্রমিকদের মৃত্যু সংবাদ মেনে নিতে পারছে না তাদের পরিবার। কী দোষ ছিল তাদের? কেন মৃত্যুর তালিকায় শুধু শ্রমিকের নামই লেখা হয়? তাদের পরিবারগুলো এখন কীভাবে চলবে? আহাজারির সঙ্গে সঙ্গে এমন নানা প্রশ্নও উচ্চারিত হচ্ছে স্বজনদের মুখে।
বিএম কন্টেইনার ডিপোতে কাউন্টারে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি পান মমিনুল, মাত্র তিন মাস আগে। তার বাড়ি বাঁশখালীতে। ছেলের চাকরিতে খুশি ছিলেন তার বাবাও। নিয়মিত কথা হতো। শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ছেলের ফোন এসে সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। প্রথমে মমিনুল বাবাকে বলেন, ‘বাবা এখানে কিছুক্ষণ পর পর বাস্ট হচ্ছে।’ এরপরই ফোন কেটে যায়। বাড়ে বাবার দুশ্চিন্তা। দ্বিতীয়বার ফোনে মমিনুল বলেন, ‘বাবা আমার একটা পা উড়ে গেছে। আমাকে কলেমা পড়ে মাফ করে দেন। আমি মাটিতে পড়ে গেছি আমাকে কেউ একটু তুলে দাও।’ এর পরই কেটে যায় ফোনের লাইন। চমেক লাশঘরের সামনে কাঁদতে কাঁদতে ফোনে মমিনুলের সঙ্গে শেষ কথাগুলো এভাবেই গণমাধ্যমকে বলছিলেন বাবা ফরিদুল হক। কতই-না কষ্ট পেয়েছে তার ছেলেটা! কেন তাকে এভাবে মরতে হলো? কার কাছে এর বিচার চাইবেন? এমন প্রশ্ন রেখে চোখের জলে বুক ভাসান শোকাহত এই বাবা।
সীতাকুন্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর আগুন ও বিস্ফোরণ কতটা ভয়াবহ ছিল তা বলে দেয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের মৃত্যুসংখ্যা। ঘটনাটিতে এমন একটি প্রশিক্ষিত বাহিনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হারাল ৯ কর্মীকে। আগুন নেভাতে গিয়ে একসঙ্গে এত কর্মীকে আগে কখনো হারাতে হয়নি তাদের। ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, এর আগে গত ৪১ বছরে যেখানে আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৭ জন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে, সেখানে সীতাকুন্ড বিএম কন্টেইনার ডিপোর একটি অগ্নিকান্ডেই প্রাণ গেল ৯ জনের। ফলে শোকাহত প্রশিক্ষিত এই বাহিনীটিও। মাত্র সাত দিন আগে কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছিলেন মনিরুজ্জামান (৩২)। ছুটি নিয়ে শিগগিরই মেয়েকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেয়ের মুখ আর দেখা হলো না তার। চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন নিজেই। শনিবার রাতে সীতাকুন্ডে কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকা- ও বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান চট্টগ্রামের কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট মনিরুজ্জামান। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তিনি। বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের নাইয়ারা গ্রামে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে মনিরুজ্জামানকে। তার অবুঝ সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী ও পরিবার এখন কী করবে?
জীবন দিতে হয়েছে আরেক ফায়ারম্যান রানা মিয়াকেও। আগুনে পুড়ে ছাই হয় তার দেহ। অঙ্গার দেহের এক পায়ে আধপোড়া বুট জানান দেয় তিনি ফায়ার সার্ভিসেরই কর্মী। পরে টি-শার্টের লোগো আর মুখের দাড়ি দেখে লাশটি শনাক্ত করা হয়। কিন্তু আগুন নেভাতে যারা পারদর্শী তাদেরই কেন মৃত্যু ঘটল? বিশেজ্ঞরা বলছেন, ওই কন্টেইনার ডিপোতে কী ধরনের রাসায়নিক আছে সেটি জানতে পারেনি কেউ। মালিকপক্ষের কাউকেই সেখানে পাওয়া যায়নি। ফলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সাধারণ আগুন মনে করেই তা নেভানোর চেষ্টা করতে এগিয়ে গেছেন অসীম সাহসে। এ ধরনের আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার স্যুটসহ যে ধরনের প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন সেটি তাদের ছিল না। আর এতেই রাসায়নিকের বিস্ফোরণ ও আগুনে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নিজেরাই ঝলসে গেছেন। তাই দাবি উঠেছে অতি দ্রুত ফায়ার সার্ভিস বাহিনীর আধুনিকায়ন করার। যা খুবই জরুরি বলে আমরাও মনে করি। পাশাপাশি হতাহতের বেশিরভাগই দরিদ্র শ্রমিক। মালিকপক্ষের লোভের আগুনে জীবন গিয়েছে যাদের, তাদের পরিবারসহ হতাহত সবার পাশে দাঁড়ানো এখন রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষের দায়িত্ব। এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে পারেন সচেতন নাগরিক সমাজও।
ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক ফ্যাক্টরি কীভাবে হলো? কেন সীতাকুন্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাখা রাসায়নিকের ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বশীলদের কাছে? ওখানে রাসায়নিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারের কোন কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়? ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা? এমন নানা প্রশ্ন উঠছে জনমনে। সেটি তদন্ত করাও জরুরি। মালিক পক্ষের রাজনৈতিক পরিচয় যেন সঠিক তদন্তকে প্রভাবিত না করে সেটি আমরা দেখতে চাই। এ ক্ষেত্রে দ্রুত তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে দোষীদের উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। আগুনে মানুষ মরার ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। কিন্তু আলোচিত ওই ঘটনাগুলো থেকে কি সত্যিই আমরা কোনো শিক্ষা নিয়েছি? উত্তর অবশ্যই ‘না’। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখ রাতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনে সূত্রপাত হয় আগুনের। সেই আগুনে ওয়াহেদ ম্যানশনসহ পাঁচটি ভবন পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়। আগুনে নিহত হন ৭১ জন, আহত হয়েছেন অনেকে। এরও আগে পুরান ঢাকার নিমতলীতে আগুন লেগেছিল। সে সময় কয়েক পরিবারের মেয়ের দায়িত্বও নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ওই ঘটনার তদন্ত করে ২০১০ সালের ১৫ জুন তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ১৭টি সুপারিশ করে। যার মধ্যে প্রধান ছিল পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো সরানো। চুড়িহাট্টা এলাকায় আগুনের পর ওই এলাকার প্লাস্টিক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন নতুন জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কেরানীগঞ্জে আলাদা রাসায়নিক পল্লী করার পরিকল্পনার কথাও আমরা জেনেছি। কিন্তু সেই উদ্যোগের অগ্রগতি কতটুকু, তা আমাদের জানা নেই। এছাড়া এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলার কার্যক্রমও চলছে ঢিমেতালে। ফলে বিচার নিয়ে মানুষের মনেও নানা শঙ্কা থেকেই যায়। যা মোটেই প্রত্যাশিত নয়।
যেকোনো দুর্ঘটনার পরের পরিস্থিতি সামলানোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বটে। সেটি সরকার করছে। কিন্তু কোনোভাবেই যেন আগুন লাগার ঝুঁকি না থাকে সেটি নিশ্চিত করা আরও জরুরি। সরকার উন্নতির সোপানে পা রেখে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার পথে এগোচ্ছে। সেখানে নিশ্চিত করতে হবে মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর। এ দেশে মানুষের জীবন অতি তুচ্ছ হোক এমনটা প্রত্যাশিত নয়। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপো, ঢাকার চুড়িহাট্টা, নিমতলী বা চকবাজারের মতো মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি আমরা দেখতে চাই না। কিন্তু সেটিই বারবার ফিরে আসছে। দুর্ঘটনা হয়তো ঘটবে। কিন্তু সরকারের কার্যকরী উদ্যোগে তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার মধ্যেই নির্ভর করবে প্রকৃত সফলতা। আর কত মৃত্যুর পর আমাদের হুঁশ ফিরবে?
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল; ৮ জুন ২০২২
© 2022, https:.