গালে চিমটি কেটে মুজিব ভাই বললেন, ‘একদিন না একদিন তোরাই হবি রাজা’
“১৯৬০ সাল। ম্যাট্রিক পাশ করে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই সিরাজগঞ্জ বিএ কলেজে। এরপর ১৯৬২ সনে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়। তখন সিরাজগঞ্জ মহকুমার সেক্রেটারি নির্বাচিত হই। প্রেসিডেন্ট ছিলেন আমির হোসেন ভুলু। সেন্ট্রালে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তখন প্রেসিডেন্ট আর শেখ ফজলুল হক মনি সেক্রেটারি। সিরাজগঞ্জে ছাত্রদের সংগঠিত করে শিক্ষা কমিশন ও আইয়ুববিরোধী তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকি আমরা। এ অপরাধে আবুল কাশেম নুরে এলাহীসহ আমাদের আটজনকে কলেজ থেকে বহিষ্কার ও ছাত্রত্ব বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। ছাত্ররা তখন ফুঁসে ওঠে। প্রিন্সিপালকে রুমে আটকেও রেখেছিল তারা। প্রতিবাদে সিরাজগঞ্জ বিএ কলেজে ক্লাস বন্ধ ছিল দুই মাস। কিন্তু ছাত্রত্ব হারিয়ে খুব ঘাবড়ে যাই। কী করব ঠিক বুঝতে পারি না! ওই সময়ই দেখা করি মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে।”
কীভাবে?
“ছাত্রত্ব বাতিল হওয়ার পর অনেকেই বললেন ঢাকায় গিয়ে রিট পিটিশন করতে। কিন্তু কার কাছে যাবো? আব্দুল রাজ্জাক ভাই তখন ছাত্রলীগ নেতা। তিনিই নিয়ে যান মুজিব ভাইয়ের কাছে। আমরা তাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। আমাদের বির্মর্ষ মুখগুলোর দিকে তাকিয়েই তিনি ঘটনা আঁচ করতে পারলেন। বললেন, ‘বুঝতে পারছি তোরা কী জন্য আইসোস।’ সব শুনে উনি দু-আঙুলে আমার গালে চিমটি কেটে বললেন- ‘ভয় পাইছিস? কিচ্ছু হবে না রে। আমি তো আছি। এদেশে একদিন না একদিন তোরাই হবি রাজা।’
আল্লাহ প্রদত্ত একটা শক্তি ছিল তার মধ্যে। প্রথম দেখায় তাকে সত্যিকারের নেতাই মনে হয়েছে। যেন আমাদের কতো আপন মানুষ। তার কথা ও উৎসাহে নিমিষেই সব দুঃচিন্তা দূর হয়ে অন্যরকম শক্তির সঞ্চার হয় মনে। একশ টাকার নোট হাতে দিয়ে শেখ মুজিব বললেন- ‘এস আর পালের (সবিতা রঞ্জন পাল) কাছে যা। উনিই তোদের রিট দাখিল করে দিবেন।’
সেটাই হলো। ওই রিট পিটশনের কারণেই ১৯৬৪ সালে হাইর্কোটের রায়ে আবার ছাত্রত্ব ফিরে পাই। কিন্তু ছাত্রআন্দোলনের কারণেই জীবন থেকে হারিয়ে যায় তিনটি বছর। সেটি নিয়ে কোনো আফসোস নেই। মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যুক্ত থাকতে পেরেছি- এটিই পরম পাওয়া। এরপর সকল আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। দেশ স্বাধীন হলে সাধারণ মানুষ চোখের জলে মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে জড়িয়ে ধরে। তখন নিজেকে রাজাই মনে হয়েছিল। মনে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর কথাটাও। তার ওই কথাগুলোই সত্য হয়েছিল। স্বাধীন দেশে সত্যিই আমরা রাজা হয়েছিলাম।”
বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু হয় যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ জেড এম আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতা। মুক্তিযুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হলেও এ মুক্তিযোদ্ধা পান না সরকারের কোনওরকম যুদ্ধাহত ভাতা। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই কথা হয় আমাদের। তিনি তুলে ধরেন যুদ্ধদিনের নানা ঘটনা ও স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।
আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর বাবা আজিজুল ইসলাম চৌধুরীও ছিলেন সংগ্রামী মানুষ। যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে, কংগ্রেস করতেন। যুক্তফ্রন্টের সময় আওয়ামী মুসলিম লীগে যুক্ত হন তিনি। দীর্ঘদিন রতনকান্দি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন। আমিনুলের মা আফতাব মহল ছিলেন গৃহিনী। তাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বাহুকা গ্রামে।
চার ভাই ও তিন বোনের সংসারে তিনি বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি বাহুকা পাঠশালায়। তিনি ভিক্টোরিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ইন্টারমিডিয়েট ও বিএ শেষ করেন সিরাজগঞ্জ বিএ কলেজ থেকে। তারপর মাস্টার্সে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা বিভাগে। ১৯৬৮সনে সারাদেশে যখন আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে তখন ঢাকা থেকে চলে যান সিরাজগঞ্জে।
আমিনুলরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে হাট-বাজারে ৬ দফার প্রচারণা করতেন। সিরাজগঞ্জ বিএ কলেজ থেকে বের হতো মিছিল। সেই মিছিলে অংশ নিতো স্কুলের ছাত্ররাও। এভাবে সিরাজগঞ্জ ছাত্রআন্দোলনের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
তাদের সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় ১৯৬৯ সালেই।
কীভাবে পেলেন ওই নির্দেশনা?
তার ভাষায়, “ওইসময় একবার সারাদেশের মহকুমা ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারিকে ডাকা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মধুর ক্যান্টিনে। বলা হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। আপেল মাহমুদ, হাসিনা মমতাজ, অজিত রায় প্রমুখ গণসংগীত গেয়েছিলেন। মূলত এ অনুষ্ঠানের অন্তরালে সারাদেশের ছাত্রলীগ নেতাদের গোপন নির্দেশনা দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘৬ দফা আন্দোলন রূপ নিবে এক দফায়। তোমরা গিয়ে ছাত্রলীগের যারা বিশ্বস্ত কর্মী আছে তাদের সশস্ত্র যুদ্ধের মন্ত্র দিবে। কেননা যুদ্ধের মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন করতে হবে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা যাবে না।’ নির্দেশগুলো দেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনি। ওই কথাগুলো মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। মূলত তখন থেকেই সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে আমরা তৈরি হতে থাকি।”
সিরাজগঞ্জে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পোড়ানো ও জাতির পিতা কায়দে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ফলে আমিনুলসহ ১৭জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতার মামলা দেওয়া হয়। ওই মামলায় জেলেও যান তারা।
ওই ঘটনার আদ্যোপান্ত তিনি তুলে ধরেন এভাবে, “২৭ অক্টোবর ১৯৬৯। পালিত হচ্ছিল আইয়ুবের বিপ্লব দিবস। গোটা সিরাজগঞ্জ শহর সরকারিভাবে জিন্নাহর ছবি ও পাকিস্তানের পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছিল। প্রতিবাদে আমরা বললাম- এটা গণতন্ত্র হত্যা দিবস, কালো দিবস। ওইদিন সিরাজগঞ্জ স্কুল-কলেজ ও মহিলা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাসহ বিশাল মিছিল বের করি। স্লোগান ওঠে- গণতন্ত্র কায়েম করো, আইয়ুব শাহী ধ্বংস হোক, বীর বাঙালি এগিয়ে চলো, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই প্রভৃতি। প্রতিবাদে ছাত্ররা কুকুরের গলায় জিন্নাহ ও আইয়ুব খানের ছবি ঝুলিয়ে শহরে ছেড়ে দেয়। ছাত্ররা স্ট্যান্ড ভেঙে পাকিস্তানের পতাকায় ও জিন্নাহর ছবিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সিরাজগঞ্জে ওইদিনই আমরা বলে ফেললাম ‘পাকিস্তান মানি না।‘ গোটা শহর ছিল ছাত্রদের দখলে। আওয়ামী লীগ নেতা মোতাহার হোসেন তালুকদার, সৈয়দ হায়দার আলী, আনোয়ার হোসেন রতু, দবিরুদ্দিন আহমেদ, ডা. জসিম উদ্দিন প্রমুখ ছিলেন সঙ্গে।“
“এ ঘটনায় আমাদের ১৭ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতার মামলা দেয়া হয়। আমিসহ আবুল কাশেম নুরে এলাহী, সোরাব আলী, ছাত্র ইউনিয়নের রেজাউল করিম সূর্য, আনিসুর রহমান, আজিজুর রহমান, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ ছিলেন আসামী। আমরা আত্মসমর্পণ করলে জামিন না দিয়ে প্রথমে সিরাজগঞ্জ সাবজেলে এবং পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাবনা জেলে। ঊনসত্তরে সারাদেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। তখন পাবনা জেলে ভেঙে অনেকের সঙ্গে বেরিয়ে আসি আমরা।”
“সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানি সামারিক জান্তা। ফলে সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। সিরাজগঞ্জেও মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। অসহযোগের মধ্যেই আমিনুলরা স্থানীয়ভাবে অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং করেন।“
কীভাবে?
তিনি বলেন, “একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। সিরাজগঞ্জ বিএ কলেজ মাঠে রাতে চলে ট্রেইনিং। প্রথম একশ জন ছিল। পরে খবরটা ছড়িয়ে পড়লে গ্রাম থেকে শত শত ছাত্র চলে আসে। ট্রেনিং করান লুৎফর রহমান অরুন নামে পাকিস্তান আর্মির একজন বাঙালি সুবেদার। ছুটিতে সিরাজগঞ্জে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন তিনি। সিরাজগঞ্জের তৎকালীন এসডিও এ কে এম সামসুদ্দিন সাহেব আনসারদের ডামি রাইফেল ও পুলিশের কিছু রাইফেল সংগ্রহ করে দেন। সেগুলো দিয়েই গুলি চালানো শেখানো হয়। ওই ট্রেইনিংটা চলে মার্চ মাস পর্যন্ত। এর পরই সিরাজগঞ্জের আপামর মানুষের অংশগ্রহণে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।“
কোথায়?
“সিরাজগঞ্জের এসডিও সাহেবের সহযোগিতা ছাড়া প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না। পুলিশের যত রাইফেল ও গুলি ছিল তা আমাদেরকে সরবরাহ করেন তিনি। পাকিস্তানিরা যেন নদী দিয়ে ঢুকতে না পারে সে কারণে আমরা নদীপথে কর্মীবাহিনী নামিয়ে দিই। এছাড়া ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ আসার একমাত্র রেলপথে প্রতিরোধ গড়ি, উল্লাপাড়ায় ঘাটিনা নামক রেলব্রিজে। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।‘ ফলে হাজার হাজার মানুষ লাঙল, ফালা, লাঠি, বর্লম, সুরকি, জোয়াল ঘরে যার যা ছিল সেটা নিয়েই আমাদের সঙ্গে ওখানে অবস্থান নেয়।“
“১০ই এপ্রিল ১৯৭১। পাকিস্তানি আর্মি ঈশ্বরদী থেকে ট্রেন নিয়ে আসে। ট্রেনের সামনে পেছনে ইঞ্জিন, মাঝখানে ওয়াগন। ওয়াগনের দরজায় বালির বস্তা দিয়ে বান্কার করা। সেখানে পজিশন নিয়েছিল সেনারা। কিন্তু ঘাটিনা ব্রিজের কাছে আসতেই আমরা ওদের প্রতিরোধ করি। সাধারণ মানুষ আগেই রেললাইন তুলে ফেলে বিভিন্ন জায়গায়। ফলে আর্মিরা ঢুকতে পারে না।“
“১৭ এপ্রিল ওরা ঈশ্বরদী থেকে বিহারিদেরও নিয়ে আসে। তারা নেমে রেললাইন মেরামত করে দিলে সেনারা ট্রেন নিয়ে সামনে এগোয়। কিন্তু এবারও আমাদের প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে। আর্মিরা তখন ক্ষিপ্ত হয়ে মর্টারসহ হেভি অস্ত্র নিয়ে ঢোকে। অনবরত গুলি চালাই আমরাও। কিন্তু গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় টিকতে পারি না। তখন সিরাজগঞ্জ শহরে চলে আসি। লাঠি হাতে হাজার হাজার মানুষ শহরে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। পাকিস্তানি সেনাদের তারা ঢুকতে দিবে না। লাঠি দিয়েই যেন ঠেকাবে। পাকিস্তানি সেনারা সিরাজগঞ্জ শহরে ঢোকার আগেই এসডিও সাহেব মাইকিং করে সবাইকে নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে বলেন। তখন চলে আসি গ্রামের বাড়িতে, শহর থেকে ২০ মাইল দূরে। বহু পরিবারও আশ্রয় নেন আমাদের বাড়িতে।”
পাকিস্তানি আর্মিরা প্রথম ওয়াপদা রেস্ট হাউজে পরে বিএ কলেজ, পিডাব্লিউডির রেস্ট হাউজ, যমুনার পাড়ের বিএল সরকারি স্কুলে ক্যাম্প বসায়। শহরের বাইরে ভাটপিয়ারী ও শৈলাবাড়ি ছাড়াও থানায় থানায় ছিল ক্যাম্প। তারপর গ্রামে গ্রামে ঢুকে বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে থাকে। তখনই যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন আমিনুল। মাত্র তিন মাস বয়সী সন্তানের মায়া আর স্ত্রীর ভালোবাসার টানকে উপেক্ষা করে দেশের জন্য ঘর ছাড়েন তিনি।
তিনি বলেন, “সিরাজগঞ্জ পুলিশের ডিআই (গোয়েন্দা কর্মকর্তা) ওয়ান গালিব উদ্দিন সাহেব ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষের লোক। একাত্তরে পালিয়ে পরিবারসহ তিনি আশ্রয় নেন আমাদের বাড়িতে। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে। সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি। পরিবারসহ তিনি রওনা হন হালুয়াঘাটের উদ্দেশে। তখন আমি, গোলাম কিবরিয়া, ইসহাক আলী, ফিরোজ ভূঁইয়া, সোরাব আলী, আব্দুর রউফ পাতা তার সঙ্গী হই। হালুয়াঘাটের সীমান্ত এলাকায় পৌঁছে তিনি আমাদেরকে ইন্ডিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন।”
কোথায় গেলেন?
“নানা জায়গা হয়ে চলে যাই কলকাতা। দেখা করি ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবের সাথে। আমাদেরকে তিনি নিয়ে যান তাজউদ্দীন আহমদের কাছে। ছাত্রলীগ করি শুনতেই বললেন, ‘ওরা বিএলএফ- এ যাক।’ রিক্রুট করেন সিরাজুল আলম খান। পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেরাদুন ট্রেইনিং একাডেমিতে।
ট্রেইনিং শুরু হলে ক্যাম্পে এসে নেতারা বললেন, ‘সর্ট ট্রেনিং দেন। ওকে আগেই ভেতরে পাঠাবো।‘ ফলে ১৫দিন ট্রেইনিং হয় আমার। এলএমজি, এসএলআর, গ্রেনেড, মর্টার শেল ও আরসিএল গান চালানো ছাড়াও এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ব্রিজ উড়ানোটাই বেশি শিখেছিলাম। ট্রেইনিং শেষে হিলি বর্ডার দিয়ে গোপন পথে চলে আসি নিজের এলাকায়, সিরাজগঞ্জের রতনকান্দি ইউনিয়নে। সঙ্গে অস্ত্র ছিল একটা রিভলবার এবং ২৫টি গুলি। ট্রেইনিং শেষে বিভিন্ন ব্যাচ ঢুকবে। তাদের দেখাশোনা, শেল্টার, সহযোগিতা ও আক্রমণের ক্ষেত্র প্রস্তুত রাখতেই আগে পাঠানো হয় আমাকে।”
এলাকায় মুক্তিবাহিনীর লোকাল একটি গ্রুপকে পান মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল। স্থানীয়ভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে ওই গ্রুপটি বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছিল। তিনি তাদের ‘মোটিভেট’ করে দলে রাখেন। ২০ দিন পর ভারত থেকে ট্রেনিং শেষে ৮ জনের গ্রুপ নিয়ে ভেতরে ঢোকেন মোজাফ্ফর। তখন সব মিলিয়ে তৈরি হয় তাদের ১৫জনের একটি গেরিলা দল। কমান্ডে ছিলেন মোজাফ্ফর।
ট্রেইনিংয়ে নির্দেশ ছিল- ‘পরিচয় দিবা না, গোপনীয়তা রাখবে, অপারেশনে জয় লাভ করলেও প্রকাশ্যে আনন্দ প্রকাশ করা যাবে না।‘ সেভাবেই গেরিলা অপারেশন করেন সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। ওইসময় কে বিএলএফ বা এফএফ- এ নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি। সবাই মুক্তিযোদ্ধা, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছে- এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়।”
এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম। সেই ক্ষত নিয়েই এখন জীবন কাটছে তার।
কী ঘটেছিল একাত্তরের ওই দিনে?
এই সূর্যসন্তান অকপটে তুলে ধরেন আদ্যোপান্ত। তার ভাষায়, “ভাটপিয়ারীতে পাকিস্তানিদের একটা শক্তিশালি ক্যাম্প ছিল এক স্কুলের ভেতর। পাকিস্তানি আর্মি, রাজাকার ও মিলিশিয়া মিলে সেখানে ছিল প্রায় ৯০জন। আমরা ৩০জন মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র ছিল ২টি এলএমজি, ৫টি এসএলআর আর অগণিত গ্রেনেড। ক্যাম্পটিতে আক্রমণের আগেই প্রতিজ্ঞা করি- লাশ হয়ে যাবো, তবু জয় না নিয়ে ফিরব না। সময়টা অক্টোবরের ১৬ তারিখ হবে। রাত ১১টার দিকে সাডেন অ্যাটাক করি। অ্যাটাকের ধরন দেখে পাকিস্তানিরা ভেবেছিল ইন্ডিয়ান আর্মি আক্রমণ করেছে। ভেতর থেকে তারা চিৎকার দিয়ে বলে- জয় হিন্দ। আমরা তখন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করি।“
“স্কুলের ছাদে ছিল ওদের দুটি বান্কার। সেখান থেকে ওরা বৃষ্টির মতো গুলি ছোঁড়ে। ফলে আমরা কিছুতেই এগোতে পারি না। আমাদের সঙ্গে ছিল দুর্ধর্ষ চারজন গেরিলা। নাম তোতা, ফরিদ, মমিন, হালিম। ওরা ছাত্র ইউনিয়ন করত। তাদের দায়িত্ব দিই বান্কারে আক্রমণের। অস্ত্র রেখে তারা কোমরে লুঙির ভাঁজে চারটা করে গ্রেনেড গুঁজে নেয়। ছাদের পাশেই ছিল বড় একটা বটগাছ। ওই গাছের একটা ডাল ছড়িয়ে চলে গেছে ছাদের ওপর। ওই ডাল বেয়ে ছাদের বান্কারে অনবরত গ্রেনেড থ্রো করেন ওই চার গেরিলা। দুইজন করে দুই বান্কারে চারজন পাকিস্তানি সেনাই তখন মারা পড়ে। আনন্দে আমরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তুলি।“
“রাত তখন আনুমানিক দুটো। পাকিস্তানিদের বলি সারেন্ডার করতে। কিন্তু তা না করে তারা কয়েকটা রুমে অবস্থান নেয়। দূরে শত শত লোক লাঠিসোটা নিয়ে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছিল। তখন আরও সাহসী হয়ে উঠি। ফলে খুশিতে স্কুল বিল্ডিংয়ের ভেতরে উঠে পড়ি। আমার সঙ্গে ছিল মোতালেব। আমরা দুজন একটা বারান্দাতে উঠতেই পেছন দিকের একটা রুম থেকে পাকিস্তানিরা গুলি ছোড়ে। গুলিটি আমার নিতম্বের ডান পাশে বিদ্ধ হয়। গুলির তোড়ে মোতালেবও ছিটকে পড়ে। প্রথম কিছু বুঝি নাই। পেছনে ব্যথা শুরু হলে নিতম্বে হাত দিতেই অনুভব করি বড় একটা মাংস খণ্ড ঝুলছে। সেখান দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছিল। চিৎকার দিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকি। সহযোদ্ধারা ছুটে আসে। রক্ত যাচ্ছিল খুব। ধরেই নিয়েছিলাম মারা যাব। আমাদের এ অবস্থা দেখে সহযোদ্ধারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ‘আমাদের নেতাকে গুলি করছে! মার শালাদের’- বলেই গুলি করতে থাকে। কিছু পাকিস্তানি আখ ক্ষেতের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু তার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে মারা যায় প্রায় ৬০জন।”
চিকিৎসা নিলেন কোথায়?
“সহযোদ্ধারা কাঁধে করে নিয়ে যায় ইটালি গ্রামে। নামকরা কমপাউন্ডার ছিলেন নুরুল ইসলাম। মেছতা গ্রাম থেকে তাকে ডেকে আনে তারা। নিতম্বে ঝুলে থাকা মাংস খণ্ডটা সেলাই করে তিনি লাগিয়ে দেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই ওই মাংসে পচন ধরে। কষ্টের মাত্রাও যায় বেড়ে। পরে মাংস খণ্ডটি কেটে ফেলা হয়।এক মাস ছিলাম বিছানায়। একেক রাতে থেকেছি একেক বাড়িতে। নিজে চলতে পারি না। সহযোদ্ধারা কান্দে করে নিয়ে গেছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। তাদের ওই ঋণ শোধ হবার নয়।”
“স্বাধীনতা লাভের পর ডাক্তার গাস্টকে দেখিয়েছিলাম সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। উনি বলেছিলেন, নিতম্বের ভেইনগুলো ছিড়ে গেছে। বয়স যত বাড়বে তত তোমার কষ্ট হবে।‘ তাই হয়েছে। পায়ের ডান পাশে এখন তেমন ব্যালান্স পাই না। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু শরীরের যুদ্ধটা থেমে যায়নি। সরকারের যুদ্ধাহত ভাতা পাই না। পাওয়ার চেষ্টাও করিনি। এগুলো নিয়ে কোন আফসোসও নেই। দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে পেরেছি- এটাই পরম পাওয়া।”
স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন দৈনিক ইত্তেফাকে। পরে স্টাফ রির্পোটার এবং সবশেষ ব্যুরো প্রধান হন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ জেড এম আমিনুল ইসলাম চৌধুরী। তিনিসহ আমির হোসেন ভুলু, দলিলুর রহমান দুলাল, আনোয়ার হোসেন রতু, আব্দুল মমিন চার্লি প্রমুখ গোপনে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। তাদের বিশ্বাস ছিল- ‘নেতা হত্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে’। কিন্তু কোন দিক থেকে কোনো সাড়া পান না তারা। বরং তাদের পরিকল্পনার কথা জানাজানি হয়ে যায়। অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রেখে শহরে ফিরতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় দুই মাস জেলও খেটেছেন এই যোদ্ধা। জিয়াউর রহমানের সরকার অস্ত্র উদ্ধারের নামে তার বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। এ কারণেই জিয়ার শাসনামলকে পাকিস্তানি আমল হিসেবেই অবহিত করেন এই সূর্যসন্তান।
যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন সেই দেশ কি পেয়েছেন?
“উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। তবে সে দেশ আমরা পাই নাই। স্বপ্ন ছিল এ দেশ হবে একটা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং শোষণহীন দেশ। মানুষ পেট পুরে খেতে পারবে, কোনো হানাহানি থাকবে না, মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ থাকবে। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুরও স্বপ্ন। কিন্তু সেটা তো এখনও হয়নি।”
স্বাধীন দেশে ভালোলাগার অনুভূতির কথা তুলে ধরেন এই বীর যোদ্ধা।
“দেশটা স্বাধীন। কী পেলাম সেটা বড় কথা নয়। বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি। ইদানিং বীর শব্দটা যুক্ত হয়েছে নামের আগে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এগুলোই ভালো লাগে।“
খারাপ লাগার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “যখন দেখি সরকারের নানা দায়িত্বশীল জায়গায় স্বাধীনতাবিরোধী চেতনার মানুষ ঢুকে পড়েছে। তখন খারাপ লাগে।”
দেশটা অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সকলস্তরে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা জরুরী বলে মনে করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ জেড এম আমিনুল ইসলাম চৌধুরী। প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “কত ত্যাগের বিনিময়ে একাত্তরে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা- তোমরা সে ইতিহাসটা জেনে নিও। স্বাধীনতাবিরোধীদের বিষয়ে সর্তক থেকো। দেশটাকে ভালবেসে এগিয়ে নিও। মনে রেখো নিজের কাজটা সততার সঙ্গে করার নামই দেশপ্রেম।”
ছবি: সালেক খোকন
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল; ১৭ জুন ২০২২
© 2022, https:.