“তখন আইয়ুব খান ক্ষমতায়। খুলনায় একটি হার্ডবোর্ড কারখানার মালিক ছিলেন এক বাঙালি। সরকার হার্ডবোর্ডের দাম দেয় কমিয়ে। ক্রমেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে ওই বাঙালি পাকিস্তানিদের কাছে কারখানা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে কৌশলে বাঙালি ব্যবসায়ীদের পুঁজি ধ্বংস করা হতো তখন। ফলে অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে পথে বসেন।
এরপরই ৬ দফার ডাক দেন শেখ মুজিব। বাঙালির মুক্তির সনদ। প্রথমদিকে আওয়ামী লীগের অনেকেই ৬ দফাকে গ্রহণ করতে চাননি। কিন্তু শেখ মুজিব তার পরিকল্পনা ও কাজে ছিলেন অটল। বড়দের আলাপচারিতায় তার কথা আমরা শুনতাম। রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম না। লেখাপড়া ও খেলাধুলা নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। তবে রাজনৈতিক সচেতন ছিলাম। বন্ধুদের আড্ডায় ও আলোচনায় উঠে আসত দেশের নানা বৈষম্য ও বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ।
খুলনায় ছাত্রনেতা ছিলেন জাহিদ ও নজরুল। আন্দোলন সংগ্রামে তাদেরই অ্যাকটিভ থাকতে দেখেছি। পরে পাকিস্তান সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। তারা ভেবেছিল সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ খুব বেশি সিট পাবে না। কেননা ইলেকশন করার কথা ছিল ভাসানী ন্যাপেরও। কিন্তু পাকিস্তানিদের সব চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করেন ভাসানী সাহেব। তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থেকে পথ ছেড়ে দেন বঙ্গবন্ধুকে। ফলে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
তাই ইতিহাসে ভাসানীর অবদানও কম ছিল না। তিনিও বড় নেতা ছিলেন, স্বাধীনতার কথাও বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর জায়গা অনেক উঁচুতে। কিন্তু ইতিহাসে তো সকলের অবদানের কথাই তুলে ধরা প্রয়োজন। তা না হলে নির্মোহ ও নির্ভুল ইতিহাস কীভাবে রচিত হবে?”
একাত্তর পূর্ববর্তী নানা ঘটনাসহ নিজের মত এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আজাদ (বীরপ্রতীক)। তার ডাক নাম দারা। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই দীর্ঘ আলাপ চলে। আলাপচারিতায় উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।
গোলাম হাসিব ও রাবেয়া বেগমের দ্বিতীয় সন্তান গোলাম আজাদ। বাড়ি নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামে। বাবা সরকারি চাকরি করতেন, টিঅ্যান্ডটিতে। বাবার বদলির চাকরির কারণে আজাদের জীবনও কাটে ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনার বিভিন্ন জায়গায়। তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি রাজশাহীতে, গনিখরমরা প্রাইমারি স্কুলে। এছাড়া বিভিন্ন সময় লেখাপড়া করেন খুলনায় টুটপাড়া মডেল স্কুল, ঢাকায় তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুল, খুলনা মডেল স্কুলে। ম্যাট্রিক পাস করেন খুলনা জেলা স্কুল থেকে, ১৯৬৯ সালে। অতঃপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন এমএম (মজিদ মেমোরিয়াল) সিটি কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ওই কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।
আলাপচারিতায় ফিরে আসি একাত্তরে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ গোলাম আজাদরা শোনেন পরদিন, রেডিওতে।
কতটা উদ্বুদ্ধ করেছিল ওই ভাষণ?
তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু যদি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা করতেন তাহলে পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে ঘোষণা করত। সরাসরি না হলেও ওই ভাষণে তিনি সকল নির্দেশনাই দেন। এরপর আর কোনো ঘোষণার প্রয়োজন হয়নি। সারাদেশে গোলাবারুদ ঠিক করে ভাষণের মাধ্যমে তিনি শুধু স্বাধীনতার আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র। ফলে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাঙালি জাতি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়।”
২৫ মার্চ ১৯৭১। সারাদেশে শুরু হয় গণহত্যা। খুলনা সার্কিট হাউজে ক্যাম্প করে পাকিস্তানি আর্মিরা। তখন খুলনা থেকে তেরখাদা ও গোপালগঞ্জ হয়ে গোলাম আজাদরা চলে যান নিজ বাড়িতে, লোহাগড়ার ইতনা গ্রামে। নিরীহ নিরাপরাধ বাঙালিকে হত্যা– এটি মেনে নিতে পারেন না তিনি। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে মনে। বুঝে যান যুদ্ধ ছাড়া পথ নেই।
ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি সেনারা টহলে বের হতো আশপাশের গ্রামগুলোতে। একবার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দেয়। অতঃপর ওই মুক্তিযোদ্ধারা সরে পড়ে। স্থানীয় লোকেরা বলে, ‘ওরা ইতনা গ্রামের দিকে গেছে।’ ফলে পাকিস্তানি সেনারা ২৩ মে ইতনা গ্রামে এসে ম্যাসাকার করে। খুব ভোরে গ্রামে ঢুকে যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করে।
আজাদরা তখন কী করলেন?
“ভোরে গুলির শব্দ পাই। মানুষ যে যার মতো ছুটে পালাচ্ছে। পরিবারসহ একটা বিল পার হয়ে আমরাও পাচুর গ্রামে লুকাই, এক দাদার বাড়িতে। দুইদিন সেখানে থাকার পর সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাওয়ার। খালাতো ভাই আক্তারুজ্জামান টুলুও সঙ্গে ছিলেন। শরাণার্থীদের সঙ্গে সাতক্ষীরার কলারোয়া বর্ডার পার হয়ে চলে যাই পাঁচ নম্বর টালিখোলা ক্যাম্পে। ওটার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন এমএনএ মতিউর রহমান।
সেখানে থেকে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতায়, ভবানিপুর আট নম্বর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। ওখানে বেসিক ট্রেনিং চলে ১০-১৫ দিন। এরপর চলে যাই চাপাবাড়িয়া ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা সবাইকে দাড় করিয়ে হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য সিলেক্ট করেন।”
হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য গোলাম আজাদদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রথম আট নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার কল্যাণীতে এবং পরে বিহার চাকুলিয়ায়। সেখানে ট্রেনিং হয় ৫ সপ্তাহ। এসএলআর, এসএমজি, স্টেনগান, অ্যাক্সপ্লোসিভসহ সব ধরনের মাইন, রেড অ্যাম্বুস, টুইঞ্চ মর্টার প্রভৃতি শেখানো হয়। তিনি ট্রেনিং করেন ৬ নম্বর উইংসে।
ট্রেনিং শেষে তারা চলে যান প্রথম কল্যাণীতে, পরে পেট্রাপোলে এবং এক সময় তাদের পাঠানো হয় নিজ এলাকায়, ইতনা গ্রামে।
বাকি ইতিহাস শুনি বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আজাদের মুখেই।
তার ভাষায়, “প্রথমদিকে অস্ত্র কম থাকায় ফিরে যাই পেট্রাপোলে। আমাদের পাঠানো হয় বয়রা সাব-সেক্টরে। যার কমান্ডার ছিলেন মেজর খন্দকার নাজমুল হুদা। তখন সেখানে জি-ফোর কোম্পানি গঠন করা হয়, এম এইচ সিদ্দিকী (কমল সিদ্দিকী) স্যারের নেতৃত্বে। তিনটি প্ল্যাটুন গঠন করে একটা প্ল্যাটুনে তিনটি করে সেকশন করে দেন তিনি। প্রতি সেকশনে ছিল ১৩ জন, ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা আর একজন কমান্ডার।
তিনটি প্ল্যাটুনের একটি ছিল হেডকোয়ার্টার প্ল্যাটুন। সেখানে সবাই ছিলেন ইপিআরের লোক। তাদের কাছে থাকত থ্রি-ইঞ্চ মর্টার। তারা কাভারিং সার্পোট দিত। আর শুধু সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করা হয় প্ল্যাটুন নম্বর-০১। এ প্ল্যাটুনের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। প্ল্যাটুন নম্বর-০২ এ ছিলেন এয়ার ফোর্স, ইপিআর, পুলিশের লোকসহ বিভিন্ন বাহিনী থেকে আসা বাঙালি সদস্যরা। প্রতি সেকশনে অস্ত্র ছিল একটি এসএমসি, এলএমজি, স্টেনগান আর অগণিত মাইন।”
বীরপ্রতীক গোলাম আজাদদের পুরো কোম্পানি মার্চ করে চলে আসে মাগুরায়, বুনোগাতি বাজারে। লোকজন জানায়, পাশেই এক স্কুলে রাজাকারদের ক্যাম্প। দিনের বেলায় পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ওই ক্যাম্পে আসে। আশপাশের গ্রামগুলোতে অত্যাচার চালায় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধারা তখন ওই ক্যাম্প দখলের পরিকল্পনা করেন।
কীভাবে করলেন ওই অপারেশন?
বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আজাদের উত্তর, “আক্রমণের পুরো প্ল্যানটি করেন কমল সিদ্দিকী স্যার। দুটি প্ল্যাটুন সামনের দিক থেকে আক্রমণ করবে। তাদের ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে শত্রুরা। পেছনটায় কোনো বাধা থাকবে না। আমি আমার প্ল্যাটুন নিয়ে পেছন দিক দিয়ে ক্যাম্পে ঢুকে যাব।
কিন্তু ইনফরমেশন ভুল ছিল। খুব ভোরে গোলাগুলি শুরু হলে পেছনে যেতেই দেখি ওদের একটা আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাঙ্কার। বাঙ্কারের পাশ দিয়ে চলে গেছে নবগঙ্গা নদী। আমরা খুব কাছাকাছি পজিশন নিয়ে থাকি।
সামনের দিকে গোলাগুলি হলে ওরা হতভম্ব হয়ে পেছনের বাঙ্কার থেকে এলোপাথাড়ি ফায়ার করতে থাকে। ওদের গুলিগুলো মাথার অনেক ওপর দিয়ে বাঁশঝাড়ে গিয়ে লাগে। বুঝে যাই ওরা না দেখেই গুলি করছে। এই সুযোগটাই নিই আমি। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর একটা গ্রেনেডের পিন খুলে ওদের বাঙ্কারে থ্রো করি। অমনি ধুম করে বিকট শব্দ হয়। বাঙ্কারে শুনি কয়েকজনের গোঙ্গানির শব্দ। একজন দৌড়ে নদীর দিকে সরে যাচ্ছিল। এসএলআরে তিনটি গুলি করি তাকে। সে নদী পার হয়ে ওপারে গিয়েই মারা যায়। তখনই ওদের ক্যাম্পে উঠে পড়ি। ভেতরে থাকা রাজাকারদের সারেন্ডার করিয়ে এক ঘরে আটকে রাখি। সব আর্মসও জড়ো করে রাখি আরেক রুমে।
সামনের গ্রুপ দুটি ক্যাম্পের দিকে তখনও গুলি করছিল। খানিক পরে এক ইপিআর ক্যাম্পে ঢুকেই দেখে আমার কাণ্ড। সবাইকে সারেন্ডার করিয়ে বসে আছি। তিনি খুব অবাক হন। আনন্দে চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘গুলি বন্ধ করো। দারা সবাইকে সারেন্ডার করিয়েছে।’ অপারেশন শেষে কমল সিদ্দিকী স্যার খুব বাহবা দিয়েছিলেন। দিনটির কথা মনে হলে এখনও অন্যরকম লাগে।”
এরপর হেডকোয়ার্টার প্ল্যাটুন বাদে পুরো কোম্পানি চলে আসে লোহাগড়ায়, ইতনা গ্রামে। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের রাখা ও খাওয়ানোর পুরো দায়িত্ব পালন করেন আজাদের মা রাবেয়া বেগম। একাত্তরে মায়ের সেই যুদ্ধের কথা অকপটে তুলে ধরেন এই বীর।
তার ভাষায়, “আম্মা ছিলেন চল্লিশের দশকে স্বদেশি আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ প্রগতিশীল এক নারী। ফলে মুক্তিযুদ্ধেও তিনি বসে থাকেননি। নিজ হাতে প্রতি বেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। প্রায় একশ মুক্তিযোদ্ধার রান্না করতেন প্রতিদিন। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন এক মামী। পাচি বিবি বলে ডাকতাম তাকে। খাবার ছিল ডাল-ভাত, শোল বা টাকি মাছের খণ্ড, মাঝেমধ্যে খিচুড়ি। যতদিন মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ততদিন আম্মা রান্না ছাড়াও তাদের সেবা-সুশ্রুষা করেছেন। চেষ্টা করেছেন নিজের সন্তানের মতোই সবাইকে ভাল রাখতে।
বাড়ি থেকেই বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন শেষে আবার ফিরে আসতাম। এতে ঝুঁকি ছিল খুব। জানাজানি হলে পাকিস্তানি আর্মিরা এসে বাড়ি জ্বালিয়ে বা সবাইকে মেরেও ফেলতে পারত। কিন্তু এসব ভয়কে তুচ্ছজ্ঞান করেই আম্মা মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে ছিলেন। একাত্তরে এমন মায়ের সংখ্যাও কম ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে মায়েদের সে যুদ্ধের কথা তেমন তুলে ধরা হয়নি। যা তুলে আনাও প্রয়োজন।”
একাত্তরের কয়েকটি অপারেশনের কথা শুনি বীরপ্রতীক গোলাম আজাদের মুখে।
“আমাদের গ্রাম থেকে ভাটিয়াপাড়া ছিল নদীর ওপারে, গোপালগঞ্জের মধ্যে। ওখানে ছিল পাকিস্তানিদের ওয়্যারলেস সেন্টার। ঢাকা থেকে খুলনা ও যশোর ওয়্যারলেসেই কানেক্ট ছিল। ওটা নষ্ট হলে আশাপাশের জেলাগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের সব যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। এ কারণেই সেখানে আর্মিদের মিনি ক্যান্টনমেন্টের মতো ছিল। ভাটিয়াপাড়ার চারপাশে তারা আন্ডার গ্রাউন্ড বাঙ্কার করে সবসময় পাহারায় থাকত।
একবার খবর আসে লঞ্চে পাকিস্তানি আর্মিরা লোহাগড়া নদী পার হয়ে কালনাঘাটের দিকে যাবে, মধুমতি নদীর একটি ঘাট ওটা। মূলত এই ঘাট দিয়েই আর্মিদের ভাটিয়াপাড়ায় যেতে হবে, ডিজেল সার্পোট দিতে। আমরা পরিকল্পনা করি ওই রুটে ওদের ঢুকতে না দেওয়ার।
সকাল তখন ৮টার মতো। কালনাঘাটে নদীর পাড়ে বাঙ্কারের মতো করে পজিশন নিয়ে থাকি। পরিকল্পনা হয় সবাই গুলি একসাথেই করার। রেঞ্জের ভেতর আসতেই ফায়ার ওপেন করি। প্রত্যুত্তরে ওরা হাজার হাজার গুলি ছোড়ে। গুলিগুলো এসে লাগে মাটিতে। এভাবে অনেকক্ষণ গোলাগুলি চলে। আমাদের গুলিতে ওদের ৬ জন সেনা মারা পড়ে। আহত হয় বেশকিছু। কয়েকজনকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তেও দেখেছি।
সকাল তখন দশটার মতো। আক্রমণের কারণে ওরা এগোতে পারে না। ফলে ব্যাক করে। নদীর পাড় দিয়ে আমরাও ওদের বরাবরে এগোই। সামনে গিয়েই আবার গুলি ছুড়ি। বিকেল ৪টা পর্যন্ত এভাবেই গোলাগুলি চলে। ওরা তখন পিঁছু হটে।”
ওরা কি ভাটিয়াপাড়ায় যেতে পেরেছিল?
“পেরেছিল। লঞ্চে খুলনা হয়ে ভাটিয়াপাড়ায় যাওয়ার ওই পথে রাতে চলে যায়। আমরা বুঝতে পারিনি। একদিন খুব ভোরবেলা লোকজন এসে খবর দেয় ওরা দুটি লঞ্চে ফিরছে। আমরা ছুটে যাই। মধুমতি নদীতে প্রচণ্ড স্রোত তখন। লঞ্চ দুটিকে কোথায় কোথায় নদীর কুল ঘেঁষে যেতে হবে সেই হিসেব করি। পরিকল্পনা করে আক্রমণের জন্য কুমোরডাঙ্গায় পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকি। ওরা রেঞ্জের ভেতর আসতেই ফায়ার ওপেন করি। দ্রুত দূরে সরে যায় ওরা।
নদীর পাড় দিয়ে আমরাও এগোতে থাকি। দূরে এক গ্রামের ঘাটে ওরা ভেড়ার চেষ্টা করে। এটা করতে পারলে ওরা ম্যাসারকার করবে। তাই আমরাও দ্রুত গিয়ে সেখানে পজিশন নিই। সেখানেও তারা বাধার মুখে পড়ে। সন্ধ্যার পর ওরা নদীপথে দূরে সরে যায়। অপারেশনের এ স্মৃতিগুলো এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। তখন ছিল শুধু একটাই চিন্তা– দেশটাকে স্বাধীন করতেই হবে।”
এরপরই গোলাম আজাদরা লোহাগড়া থানা ও নড়াইল দখলে নেয়।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও ভাটিয়াপাড়ায় তখনও চলছে যুদ্ধ। বয়রা সাব-সেক্টরের কমান্ডার মেজর খন্দকার নাজমুল হুদা ও জি-ফোর কোম্পানির কমান্ডার এম এইচ সিদ্দিকীসহ (কমল সিদ্দিকী) গোলাম আজাদরা মুভ করে সেখানে।
তার ভাষায়, “পাকিস্তানি সেনাদের শাক্তিশালী ঘাঁটি ছিল ওটা। আমরা ওদের পূর্বদিকে অবস্থান নেই। হুদা স্যার ওয়াকিটকিতে নিদের্শে দিলে পেছন থেকে আর্টিলারি সার্পোট আসে। বিভিন্ন জায়গায় পজিশনে সবাই। তুমুল ফায়ারিং চলছে। হঠাৎ বাঁ দিক থেকে একটা গুলি এসে কমল সিদ্দিকী স্যারের ডান চোখকে বিদ্ধ করে। উনি ছিটকে পড়েন। প্রথম বুঝতে পারিনি। হুদা স্যার চিৎকার দিয়ে বললে আমরা ছুটে যাই কমল সিদ্দিকীর কাছে। পরে তাকে লঞ্চে নড়াইল পর্যন্ত দিয়ে আসি। আমাদের কমান্ডারকে গুলি করছে। আমরা ঠিক থাকতে পারি না।
তুমুল গোলাগুলি চলে ওদের সঙ্গে। একদিন পরেই ওরা সারেন্ডার করার মতো পজিশনে চলে যায়। কিন্তু তবুও সারেন্ডার করে না। ভয় পাচ্ছে যদি গুলি করে মেরে ফেলি। ফলে অস্ত্র ছাড়তে চায় না। ওই সময়ই আসেন ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম আবুল মঞ্জুর। তার হুংকারেই পাকিস্তানি আর্মিরা অস্ত্র ফেলে সারেন্ডার করে। কিন্তু একজন পাকিস্তানি সোলজার সারেন্ডার মেনে নিতে পারেনি। নিজের অস্ত্র বুকে ঠেকিয়েই গুলি করে। পরে সে বেঁচেছিল কিনা আমার জানা নেই। এভাবেই ১৯ ডিসেম্বর ভাটিয়াপাড়া মুক্ত করি আমরা।”
স্বাধীনতা লাভের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আজাদ ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ভর্তি হন খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। লেখাপড়া শেষে চাকরি করেন যথাক্রমে পিডিবি, টিঅ্যান্ডটি ও পিডাব্লিউডিতে। সততার সঙ্গে চাকরি করে এই বীর সর্বশেষ পিডাব্লিউডির এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হন। সাদামাটা জীবনবোধ নিয়ে এখনও চলেছে তার জীবনপ্রবাহ।
অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। মৃত্যুর ভয়ও ছিল। তবুও কেন মুক্তিযুদ্ধে গেলেন?
মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আজাদ বলেন, “রাজনীতি করতাম না। কিন্তু দেশের জন্য পাগল ছিলাম। পরিবারে বাবা-মাও প্রভাবিত করেছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ভাবনাটাই তখন ছিল সাধারণ ব্যাপার।”
তিনি আরও বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়টা ছেলে বা কয়জন শিক্ষক সরাসরি যুদ্ধ করেছে, কয়জন উকিল বা সাংবাদিকের নাম বলতে পারবেন যারা যুদ্ধ করেছে। খুব কম। উচ্চবিত্ত খুঁজেও পাবেন না। যেখানে মরে যাওয়ার ভয় আছে সেখানে সুচিন্তিত লোকেরা যায় না। একাত্তরে কারা যুদ্ধ করছে জানেন? যারা উচ্চ শ্রেণির কাজের মানুষ ছিল মানে একেবারেই সাধারণ মানুষ। স্বাধীনতা লাভের পর ওই উচ্চবিত্ত শ্রেণি কি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চেয়ার ছেড়ে দিয়েছে? অবশ্যই দেয়নি। এ কারণেই অনেক জায়গায় এখনও মুক্তিযোদ্ধারা সম্মান পান না। পৃথিবীর সব দেশেই বড় সমস্যা বুক দিয়ে ঠেকায় সমাজের তৃতীয় শ্রেণির লোকেরাই।”
এত বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?
এই যোদ্ধার অকপট উত্তর, “তখন গ্রামের চেয়ারম্যান ছিল, তার বাড়িতেই মুক্তিযোদ্ধারা খেয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর এখন তাকেও মুক্তিযোদ্ধা হতে হবে। শ্রেণিগত দ্বন্দ থেকেই এটা ডেভেলপ হয়েছে। শুরু করছে এরশাদ। এখন এটা চলতেই থাকবে। আবার ধরেন ম্যাট্রিক সনদ বাতিল করে দেওয়া হলো। এরপর বলা হলো দুইজন শনাক্ত করলেই আপনি ম্যাট্রিক পরীক্ষার সনদ পাবেন। আপনি ঠেকাতে পারবেন কাউকে। জানালা যখন খুলে দেবেন তখন শুধু ভাল বাতাস আসবে এটা আশা করতে পারেন না। তাই সংখ্যাটা বাড়বেই। কারণ যে শ্রেণি এটা বন্ধ করবে সেই শ্রেণিই তা খুলে রাখছে।”
দেশের টাকায় এখন দেশের মানুষই উপকৃত হচ্ছে। পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নত হচ্ছে। এটি দেখলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মন ভরে যায় এই বীরপ্রতীকের। কিন্তু কষ্ট পান অসততা ও দুর্নীতির খবরে।
তবে শত বাধা পেরিয়ে প্রজন্ম এগিয়ে নিয়ে যাবে দেশটাকে। এমন স্বপ্নে বিভোর হন বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আজাদ (বীরপ্রতীক)। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “তোমরা দেশকে ভালবেসো। নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলো। নিজের কর্ম সততার সঙ্গে করাটাই বড় দেশপ্রেম। দেশও তখন অটোমেটিক উঠে যাবে। আমার বিশ্বাস তোমরা অবশ্যই জয়ী হবে।”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৫ জুলাই ২০২২
© 2022, https:.