বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ হয়েছিল যেভাবে
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার হত্যাকাণ্ডের পর একেবারেই প্রতিবাদ হয়নি বলে একটি পক্ষ প্রচার চালিয়ে এসেছে। প্রতিবছর আগস্ট এলেই সেই প্রচারকার্য আরও গতি পায়। প্রতিবাদ হয়নি এমন প্রচারণার মাধ্যমে তারা মূলত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে।
নানা তথ্য-উপাত্ত বলছে, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ওই দিনই মিছিল বের হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ বরগুনা, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, খুলনা, যশোর, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, ময়মনসিংহের গফরগাঁও প্রভৃতি জেলায়। কিন্তু পুলিশ ও সেনাদের বাধার মুখে তা টিকতে পারেনি। তবু জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ থেমে থাকেনি।
তৃণমূলের বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা ১৫ আগস্টের পর সশস্ত্র প্রতিবাদের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কিছু দিন আগে তাদের মুখোমুখি হই। আলাপচারিতায় উঠে আসে ১৫ আগস্টের প্রতিবাদের অজানা সব ইতিহাস।
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক বীর প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ১১ নম্বর সেক্টরে, কাদেরিয়া বাহিনীতে। ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। ঘৃণ্য এই হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেনি তিনি। তারা প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের প্রস্তুতি নেয়। সেটি করতে গিয়ে তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গ্রেফতার হন মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক । তার ওপর চলে নির্মম অত্যাচার। চোখের কোণে অশ্রু জমিয়ে সেই ইতিহাসের কথাই বলেন এই বীর যোদ্ধা।
তার ভাষায়, “বঙ্গবন্ধু আমাদের অন্তরের মানুষ ছিলেন। তাই তার হত্যাটাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি নাই। চেয়েছিলাম অস্ত্র হাতে প্রতিশোধ নিয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে। কিন্তু সেটি যে খুব কঠিন কাজ ছিল তা বুঝতে পারিনি। আমি, জাহাঙ্গীর হোসেন তালুকদার ও হায়দার সিকদার– এই তিন জন বর্ডার পার হয়ে চলে যাই ভারতে, মাহেন্দ্রগঞ্জে। সেখানে গিয়ে পাই আশরাফ গিরাণী, আব্দুল্লাহ বীর প্রতীক, দুলালসহ অনেককে। কাদের সিদ্দিকী আমাদের সশস্ত্র প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন। কয়েক দিন ট্রেনিংয়ের পর গোপনে আমরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ঢুকি বাংলাদেশে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ মাটির নিচে লুকিয়ে রাখি ভুয়াপুরের নলিন এলাকায়। পরে চলে আসি ঘাটাইলে, গ্রামের বাড়িতে। আমাদের সশস্ত্র প্রতিবাদের খবরটি জানাজানি হয়ে যায়। ফলে আমাকে তুলে নিয়ে যায়। কিছু দিন টাঙ্গাইলে রাখার পর পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। প্রতিদিন সকাল বিকাল চলতো নিদারুণ টর্চার। সেই টর্চারের কষ্টের কথা ঠিক বোঝাতে পারবো না ভাই। তিনটি প্রশ্ন করা হতো তখন– অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোথায়, কারা সঙ্গে আছে, কাদের সিদ্দিকী কোথায়? মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। সেই স্বাধীন দেশে টর্চারও সহ্য করেছি। তবু মুখ খুলিনি। বঙ্গবন্ধুর জন্য ওটাই ছিল আরেক যুদ্ধ। পরে আমাকে তিন বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়। ফলে মানসিক ও শারীরিকভাবেও প্রচণ্ড ভেঙে পড়ি।”
আপনারা সফল না হওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?
তিনি বলেন “কিছু পরিকল্পনায় ভুল ও নিজেদের মধ্যে অনৈক্য ছিল। ভেবেছিলাম নেতাদের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন ও সহযোগিতা পাবো। কিন্তু সেটা আমরা পাইনি। ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনও একটা বড় কারণ ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমার মতো অনেকে টর্চার ও সাজা ভোগ করেছে, ১০৪ জন মারাও গেছেন। কিন্তু এই ইতিহাসের স্বীকৃতি এখনও দেওয়া হয়নি। তবে এ নিয়ে আফসোস নেই কোনও। বরং আমি গর্বিত। জাতির জনকের হত্যার প্রতিবাদটুকু অন্তত করতে পেরেছি।”
এ প্রসঙ্গে কথা হয় সাব-সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগের সঙ্গে। তিনি ক্যাপ্টেন বেগ নামে অধিক পরিচিত। একাত্তরে প্রথমে নয় নম্বর সেক্টরের অপারেশনাল কমান্ডার এবং পরে শমশেরনগর সাব-সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে মাহফুজ আলম বেগ পরিচালক হিসেবে যোগ দেন ওয়াপদায়। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। আগে থেকেই খন্দকার মোশতাকের ক্ষোভ ছিল বেগের প্রতি। তিনি বলেছিলেন, ‘জীবিত বা মৃত বেগকে চাই।’ এরপরই বেগকে খুঁজতে ক্যাপ্টেন মাজেদ তার আত্মীয়-স্বজনের বাসায় রেইড দিতে থাকে। একপর্যায়ে তিনি ইন্ডিয়ায় চলে যান। দেরাদুনে তারা ‘মুজিবস আইডোলজিক্যাল ফোর্স’ নামে একটি ফোর্সও গঠন করেন। ট্রেনিংও চলে সেখানে। সঙ্গে ছিলেন শেখ সেলিম, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহসহ অনেকেই।
কী ছিল এই ফোর্সের উদ্দেশ্য?
মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগ বলেন, ‘দেশে ফিরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সংগঠিত করে দীর্ঘমেয়াদি কিছু করাই ছিল উদ্দেশ্য। এ ব্যাপারে ভারতীয় সরকারেরও সহযোগিতা পাই। কিন্তু দেশে ফিরেই অনেক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ হতেই হতাশ হই। বড় বড় নেতারাই ধমকের সুরে সে সময় বলেছিল, ‘তুমি আবার আসলে পুলিশে ধরায়া দিমু।’ মোশতাকের ক্যাবিনেটে কারা ছিল বলেন? এরপরই আমি সেমি কট হই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে বলা হলো সারেন্ডার করতে। সারেন্ডার করি। বহু কষ্টে চার বছর পর চাকরি ফিরে পেয়েছিলাম। কিন্তু চার বছরের বেনিফিট পাইনি। ওই সময়টা কেটেছে নানা অবহেলা আর আতঙ্কে।’
ওয়াপদার পরিচালক হিসেবে সততার সঙ্গেই চাকরি জীবন শেষ করেছেন এই বীর। নিজের কোনও বাড়ি নেই তার। সাব-সেক্টর কমান্ডার হয়েও পাননি কোনও সরকারি প্লট। থাকছেন ভাড়া বাসায়। রাষ্ট্রীয় কোনও অনুষ্ঠানের দাওয়াতও এখন পৌঁছায় না তার বাড়িতে। এ নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই। বরং এখনও দেশ নিয়েই স্বপ্ন দেখেন এই বীরযোদ্ধা।
কথা হয় সিরাজগঞ্জের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এজেডএম আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে। স্বাধীনতা লাভের পর তিনি সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন দৈনিক ইত্তেফাকে। পরে স্টাফ রিপোর্টার এবং সবশেষ ব্যুরো প্রধানও হন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি তিনি। আমির হোসেন ভুলু, দলিলুর রহমান দুলাল, আনোয়ার হোসেন রতু, আব্দুল মমিন চার্লি প্রমুখ সিরাজগঞ্জে গোপনে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। তাদের বিশ্বাস ছিল- ‘নেতা হত্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে’। কিন্তু কোনও দিক থেকে কোনও সাড়া পান না তারা। বরং তাদের পরিকল্পনার কথা জানাজানি হয়ে যায়। অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রেখে শহরে ফিরতেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় দুই মাস জেলও খেটেছেন এই যোদ্ধা। জিয়াউর রহমানের সরকার অস্ত্র উদ্ধারের নামে তার বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। এ কারণেই জিয়ার শাসনামলকে পাকিস্তানি আমল হিসেবেই অবহিত করেন এই সূর্যসন্তান।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল্লাহও (বীর প্রতীক)। একাত্তরে কাদেরিয়া বাহিনীর অধীনে তিনি যুদ্ধ করেছেন টাঙ্গাইলের বাসাইল নথখোলা, ঘাটাইল, নাগরপুর ও কালিহাতিতের বিভিন্ন স্থানে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিতে পারেনি এই বীর প্রতীক। তারা প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের প্রস্তুতি নেয়। সেটি চলে কয়েক বছর। সেই ইতিহাস শুনি এই বীরের মুখে। তার ভাষায়, ‘আমার এক মামা চাকরি করতো ময়মনসিংহে। উনি মুসলিম লীগরে সাপোর্ট করতো। তার বাসায় গেছি ওই দিন। উনি বললেন, ‘তোর বঙ্গবন্ধুরে তো মাইরা ফালাইছে।’ শুনেই মাথাটা চক্কর দিলো। বুকের ভেতরটা কাইপা ওঠে। কারফিউ কয়েক ঘণ্টার জন্য তুললে চলে যাই এলাকায়, ভালুকায়। কী করমু বুঝতে পারি না। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘাটাইলে এক মামার বাড়িতে আইসা থাকি। ১৫-২০ দিন পরে কাদের সিদ্দিকী লোক পাঠায়। তহন হালুয়াঘাট দিয়ে বর্ডার পার হয়ে ভারতে চইলা যাই। পরিকল্পনা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ নেওয়ার। কয়েক দিন পর দেশে ঢুকি। ঢাকায় ও টাঙ্গাইলে এসে যোগাযোগ করলাম নেতাদের সাথে। মুক্তিযোদ্ধাদের লগেও কথা কইলাম। অনেক মুক্তিযোদ্ধাই আগাইতে চাইল না। কারণ, দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপরও অস্ত্র উদ্ধারের নামে অত্যাচার হইছে। তাই ওরা রাজি হয় না। আমগো পিছেও গোয়েন্দা লাইগা যায়। দেশে আসার সময় গ্রেনেড নিয়া আসছি, কিছু অস্ত্রও ছিল। ওইগুলা গোপালপুর কলেজের ভিপির কাছে রাইখা দিলাম। এ খবরও জানাজানি হয়। পরে তার বাড়িতে মিলিটারি যায়। ওরা কাদের সিদ্দিকীকে খুঁজছিল। দশ-বারো জন ছিলাম আমরা। যে যার মতো পালায়া থাকি। কয়েকদিন পরেই কাদের সিদ্দিকীর সাথে দেখা হয়।”
“উনিসহ যমুনায় গুনটানা নৌকায় থাকি। আর্মস অ্যামুনেশন ছিল একটা নৌকায়। আরেকটাতে তিনিসহ আমরা ১০-১২ জন। সিরাজগঞ্জের নিশ্চিন্তপুর যাওয়ার পথে মিলিটারির সাথে আমগো গোলাগুলি হয়। বগুড়া যুবলীগের খসরু তহন মারা যায়, আমার কোলেই। ওর বুকে গুলি লাগছিল। মিলিটারিদেরও কয়েকজন মারা পড়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে এ রকম গোলাগুলি করছি দেড় বছর। তহন তো আমার দেশদ্রোহী। বর্ডার এলাকায় লুকাইয়া সিলেট, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ি, রংপুর, মহেশখোলা পর্যন্ত যুদ্ধ করছি। বারোবাড়ি ও নকলা বিডিআর ক্যাম্পও দখল করছিলাম। ঢাকার কমলাপুর থানা দখল কইরা ওসিরে নিয়ে গেছি পরিবারসহ। হালুয়াঘাটের ওসিকেও গুলি করছি। ওই সময় দুলাল, আমি, মান্নান একত্রে থাকতাম। ১০৪ জন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়া মারা গেছে। আমার সাথের চার জনও ছিল- কুমিল্লার ছেলে রতন, বগুড়ায় খসরু, দুলাল, মান্নান। পরে তো আর পারলাম না! আফসোস এই ইতিহাসের স্বীকৃতি দেওয়া হয় নাই। জাতির পিতার নামে দেশ চলছে অথচ তার হত্যার প্রতিবাদ যারা করলো, প্রতিশোধ নিতে গিয়া যারা মারা গেলো, তাদের কোনও স্বীকৃতি নাই।”
এই সশস্ত্র প্রতিরোধ থেমে যাওয়ার কারণ কী?
“কিছু পরিকল্পনায় ভুল ছিল আমাদের। অনেক নেতাদের পূর্ণাঙ্গ সমর্থনও তখন আমরা পাইনি। আবার ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণেও এগোতে পারি নাই। তবে এই প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের স্বীকৃতি না দিলেও আমরা গর্বিত। জাতির জনকের হত্যার প্রতিবাদটুকু অন্তত হয়েছে।”
আমরা মনে করি, জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ নিয়ে আরও বিশদ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। যেটি এখনই শুরু করা দরকার। পাশাপাশি রাজনৈতিক জায়গার ঊর্ধ্বে থেকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর কয়েক বছরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের যারা প্রতিবাদ করেছেন, শহীদ হয়েছেন, তাদের স্বীকৃতি প্রদানই হতে পারে সরকারের নির্মোহ সিদ্ধান্ত।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউনে, প্রকাশকাল: ১৫ আগস্ট ২০২২
© 2022, https:.