সুফিয়া খাতুনের রক্তমাখা কোরআন শরিফ
সৈয়দপুরে বিহারিরাই নেতৃত্ব দিত। ছয় দফার আন্দোলন চলছে তখন। ফলে ওদের সঙ্গে আমাদের ভেদ তৈরি হতে থাকে। উর্দু ভাষায় নিজেদের মধ্যে নানা আলোচনা করত ওরা। প্রকাশ্যে শেখ মুজিবকে গাদ্দার বলত, গালিও দিত। শুনে ঠিক থাকতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা দেশে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। স্টেডিয়ামের নাম উর্দুতে লেখা ছিল। তা আলকাতরা দিয়ে মুছে দিয়েছিলাম। ১৯৭০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করব আমরা। আগেই টাকা তুলে ইট, বালি ও সিমেন্ট দিয়ে স্কুলমাঠে একটা শহীদ মিনার তৈরি করি। কিন্তু রাতের আঁধারে বিহারিরা মেথরদের দিয়ে বাইরে থেকে মল (পায়খানা) এনে ওই শহীদ মিনারের বেদিতে ফেলে রাখে। সকালে এ দৃশ্য দেখে বুকের ভেতর আগুন জ্বলে ওঠে। ওদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে। কিন্তু তার আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন তৎকালীন এসডিও। নিজ উদ্যোগে শহীদ মিনার পরিষ্কার করে দেন তিনি। পরে সেখানে আমরা শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। পাকিস্তানিদের মতো বিহারিরাও বাঙালিদের ঘৃণার চোখে দেখত।
সত্তরের নির্বাচনের সময় ঘটে আরেক ঘটনা। কলোনির পাশে চিকা (দেয়াল লেখা) মারছিলাম। পরিচিত এক বিহারি ছেলে এসে বলে, ‘শেখ মুজিব গু-া হ্যাঁ’। শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায়। নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। ঘুষি দিয়ে ওর নাক ফাটিয়ে দিই। মুহূর্তের মধ্যে অনেক বিহারি একত্র হয়। ওরা আক্রমণ করে আমার নাকও ফাটিয়ে দেয়, নাকের নিচের ডগাটা আজও ভাঙা।
একাত্তরকে ঘিরে সৈয়দপুরে বাঙালিদের ওপর বিহারিদের অত্যাচারের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মুরাদ হোসেন। বর্তমানে তিনি রাজধানী ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর।
আমজাদ হোসেন সিকদার ও সুফিয়া খাতুনের বড় সন্তান মুরাদ হোসেন। বাবা ছিলেন অ্যাকাউন্টস অফিসার, রেলওয়েতে। সে সুবাদে থাকতেন সৈয়দপুর শহরে, আতিয়ার কলোনির এল-৭৬-বি নম্বর কোয়ার্টারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী।
ছোটবেলায় চঞ্চল ও ডানপিটে ছিলেন মুরাদ। মা খুব শাসন করতেন। তিনি শিক্ষানুরাগী ছিলেন। মাগরিবের নামাজের পর মুরাদদের নিয়ে পড়তে বসাতেন। পাশে বসে তিনিও লাইব্রেরি থেকে আনা বই পড়তেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতেন না। বলতেন‘পড়াশোনা আগে। তারপর অন্যকিছু।’ মায়ের আদর্শে এভাবেই বেড়ে ওঠেন তারা।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সৈয়দপুরসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বিহারিরাও তখন বাঙালির ওপর চড়াও হয়। মুরাদের ভাষায়, ‘বিহারিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। ওদের নেতা ছিল মতিন হাশমি, সৈয়দপুর কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। পুরো বিহারি এলাকার নেতৃত্ব দিতেন। প্রকাশ্যে তিনি ঘোষণা দেন, ‘২৩ মার্চ যুদ্ধ হবে। বোঝাপড়া হবে এ দেশে আমরা থাকব নাকি বাঙালিরা।’
এরপর থেকে সৈয়দপুরে বাঙালি-বিহারি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ২৪ মার্চ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সিভিল ড্রেসে বেরিয়ে আসে। মাথায় গামছা বেঁধে তারা মেশিনগান দিয়ে ফায়ার শুরু করে। ফলে পাখির মতো বাঙালি মরে। হাজার হাজার লাশ দেখে তৎকালীন এসডিও মুয়ীদ চৌধুরী থানায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা তখন গ্রামের দিকে লুকিয়ে থাকি।
কলোনির কোয়ার্টারে তখন তার মা সুফিয়া খাতুনের সঙ্গে থাকত দূরসম্পর্কের এক বোন, নাম জোবাইদা। কিন্তু মুরাদ কলোনিতে ফিরতে পারে না। তার মাথার দামও ঘোষিত হয় প্রকাশ্যে। জীবিত বা মৃত তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০০ টাকা দেবে বিহারিরা। এতেই তারা ক্ষান্ত হয় না। বাড়িতে আক্রমণ করে মুরাদের মমতাময়ী মাকে দ্বিখ-িত করে হত্যা করে।
সে ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে বারবারই থেমে যান মুরাদ হোসেন। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে তিনি বলেন শহীদ মাতার আত্মত্যাগের করুন ইতিহাসটি
‘সৈয়দপুর শহরের সব বাঙালিকে ওরা আটকে রেখেছিল। আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিল তাদের ফ্যামেলিকেও বাঁচতে দেয়নি। ১৪ এপ্রিল রাতে আম্মাকে ওরা নির্মমভাবে হত্যা করে। কলোনিতে ওটাই ওদের প্রথম অ্যাটাক। মেইন রোডের পাশেই ছিল আমাদের কোয়ার্টার, ছাদ দেওয়া একতলা বাড়ি। মার্চের শুরুতেই ছাদের ওপর বিশাল সাইজের একটা বাংলাদেশের পতাকা ও একটা কালো পতাকা লম্বা বাঁশ দিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা দেখা যেত অনেক দূর থেকে। রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করত পাকিস্তানি আর্মি। বাংলাদেশের পতাকা দেখে তারা ক্ষিপ্ত হয়।
বিহারিরা এসে প্রথম আম্মাকে বলে, ‘উসকো উতার দো’। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে টাঙিয়েছে। এটা আমি নামাতে পারব না।’ ওরা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি আর্মিদের ভয় দেখিয়ে আবারও পতাকা নামাতে বলে। এবারও আম্মা অস্বীকৃতি জানান। তাকে ধাক্কা দিয়ে ছাদে ওঠার চেষ্টা করে ওরা। কিন্তু আম্মার বাধার কারণে পারে না। ফলে হুমকি ও গালাগাল করে চলে যায়।
এর কিছুক্ষণ পরই আর্মিসহ বিহারিদের একটি সশস্ত্র দল এসে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। মা তখন রেহালে নিয়ে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। পেছনের দরজা দিয়ে তিনি ওই বোনটাকে পাঠান পাশের বাড়িতে, আব্বার বন্ধুকে ডেকে আনতে। কিন্তু পথের মধ্যেই বিহারিরা বোনটাকে কুপিয়ে হত্যা করে। সামনের দরজা ভেঙে তারা ঘরের ভেতরে যখন ঢোকে, আম্মা তখন কোরআন শরিফ বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন। ওদের কাছে প্রাণভিক্ষাও চান। কিন্তু পিশাচদের মন গলে না। কোরআন শরিফ ধরা অবস্থাতেই আম্মাকে ওরা কোপ দিয়ে দেহ থেকে কল্লা আলাদা করে ফেলে। রক্তে ভেসে যায় পুরো ঘর। আল্লাহর কালাম কোরআন শরিফও মাটিতে পড়ে রক্তে ভিজে যায়। মুসলমান হয়েও বিহারিরা এমন বর্বরতা চালিয়েছিল। পরে আম্মার লাশ পাকিস্তানি আর্মিরা ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। তার লাশটাও ফেরত দেয়নি ওরা।
আশপাশের পরিচিতজনরা প্রত্যক্ষ করে আম্মার করুণ ও নির্মম মৃত্যু। তাদের মুখেই শুনেছি সবকিছু। বিহারিরা চলে গেলে পাশের বাসার একজন ঘর থেকে আম্মার রক্তমাখা কোরআন শরিফটি তুলে নেন। রক্তমাখা ওই কোরআন শরিফটাই আমাদের মায়ের শেষ স্মৃতি। যার পাতায় পাতায় এখনো রয়েছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
কোরআন শরিফটা হাতে নিলে বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। স্বপ্নে আম্মার চিৎকার শুনে জেগে উঠি প্রায়ই। তখন খুব কষ্ট লাগে। এই দুঃখের কথা ঠিক বোঝাতে পারব না ভাই। দেশ তো স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমরা তো মাকে ফিরে পাইনি, তার লাশও পাইনি। ফলে তার কবরও নেই। পুরো দেশের মাটিতেই মিশে আছে আমার মায়ের রক্ত। কিন্তু এ দেশ কি মনে রাখবে আমার শহীদ মাকে?
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে আমরা মনে করি একাত্তরের গণহত্যায় যুক্ত বিহারিদেরও বিচার করা উচিত। পাশাপাশি প্রয়োজন সুফিয়া খাতুনের মতো শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১ সেপ্টেম্বর ২০২২
© 2022, https:.