বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ
বাল্যবিয়ে-বিষয়ক প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনার কথা তুলে ধরছি প্রথমেই। বছর-পাঁচেক আগের কথা। ইউনিসেফের কার্টুন চরিত্র মীনা নামেই মঞ্চ করে একজোট হয় পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসার ছাত্রীরা। তারা নিজেরাই রুখে দিতে থাকে বাল্যবিয়ে। কেমন ছিল এই মঞ্চ? ছাত্রীদের মধ্যে একজন নেতা থাকে। তার তদারকিতেই সব কাজ চলে। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দুই ২৪ পরগনার পাশাপাশি হাওড়া, হুগলি ও কলকাতার বিভিন্ন মাদ্রাসায় এই মঞ্চ হয়। প্রতি মাদ্রাসায় ২০-৩০ জন ছাত্রী ও একজন শিক্ষক নিয়ে গঠন হয় দলটি। মীনা মঞ্চের প্রথমদিকের বাল্যবিয়ে রোধের অভিজ্ঞতাও উঠে আসে সংবাদে। অষ্টম শ্রেণির নাসরিন ইয়াসমিন। বয়স ১৩ বছর। তার বিয়ের খবর পেয়ে মীনা মঞ্চের মেয়েরা তা ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু কদিন পরেই নাসরিনকে মামার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়। ছয় মাসের মধ্যে ডিভোর্স নিয়ে ফিরে আসে সে। এরপর নাসরিন মীনা মঞ্চের অন্য মেয়েদের সঙ্গে যোগ দেয়।
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে মীনা মঞ্চের মেয়েরা খুবই সক্রিয়। বিয়ের খবর ওরাই জোগাড় করে। এমনকি কোনো ছাত্রীর বাড়ির আশপাশে ঘটক ঘোরাফেরা করতে দেখলেই তারা সন্দেহ করা শুরু করে। এভাবে সেখানে এখনো কাজ করছে মিনা মঞ্চের মেয়েরা। এই মঞ্চকে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করছে ইউনিসেফ। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে কমছে নাকি বেড়েছে? বিভিন্ন তথ্য বলছে, বাল্যবিয়ে বন্ধের লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে বাংলাদেশ। সাত বছর আগে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৫ ও ১৮ বছরের কম বয়সীদের বাল্যবিয়ে কমানোর লক্ষ্যমাত্রা জানানোর পাশাপাশি ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নির্মূলের অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন। সে লক্ষ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে শূন্যের কোঠায় নামানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু সেটি অর্জিত হয়নি। একাধিক গবেষণায় দেখা যায়, ভুয়া জন্মসনদ আর কাজির কারচুপির সাহায্যে অভিভাবকরা অনায়াসে বাল্য বিয়ে দিচ্ছেন। ধরা পড়লে কিছু সাজা হলেও বিয়ে হয়ে গেলে তা অবৈধ বা বাতিল হচ্ছে না। উদ্ভাবনী উপায়ে বাল্যবিয়ে নিরোধ নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালে একটি বই বের হয়। বইটিতে এ দুটি বিষয়কে বাল্যবিয়ে চলার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আবার বাল্যবিয়ের মামলা থেকে রেহাই পেতে ভুয়া নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বয়স বাড়িয়ে দেখানোসহ বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে ধর্ষণের মামলায়ও অনেক অভিযুক্ত আসামি ভুক্তভোগীকে বিয়ে করে রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন। এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়াসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে যারা বাল্যবিয়ের নিমন্ত্রণে যান, তাদেরও আইনের আওতায় আনার কথা গণমাধ্যমকে বলছেন বিচার-সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি যুক্ত রয়েছে কিছু ইস্যুও, যা আমরা তেমন গুরুত্বের সঙ্গে দেখি না। বাল্যবিয়ে কারা দেন? প্রধানত মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনসহ সমাজের কিছু মানুষও এতে উৎসাহিত করে থাকেন। তাই মা-বাবার মানসিকতার পরিবর্তনের দিকটিতে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। মা যখন গর্ভবতী থাকেন, তখন মা ও তার স্বামীকে বাল্যবিয়ের ক্ষতিসহ উন্নত জীবন সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। তা ছাড়া ছেলে বা মেয়ে হোক উভয়কেই মানুষ হিসেবে বড় করার প্রচেষ্টার শিক্ষা পরিবারে লিঙ্গবৈষম্য কমাবে। ঘরের কাজ মানে নারীর কাজ। এটা আমাদের সমাজে ভীষণভাবে প্রতিষ্ঠিত। গ্রামপর্যায়ে এমন অনেক পরিবার আছে যারা ছেলের বিয়ের কথা চিন্তা করে সংসারে বাড়তি আয় ও একজন কাজের মানুষের প্রয়োজনে।
প্রত্যেক মেয়ের জন্য জীবন দক্ষতামূলক শিক্ষা জরুরি। যার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরী নিজেরা সচেতন হবে। তারা নিজেরাই নিজেদের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারবে। তাই কিশোরী ক্লাব গঠন ও সংগঠনগুলোকে সচল করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, আত্মীয়স্বজনসহ আশপাশের মানুষের চাপ বিভিন্ন কারণে বাল্যবিয়ে হয়। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে অভিভাবকরা অনেক সময় মেয়েদের বিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনরা মেয়ের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পান না। ফলে বন্ধ হয় মেয়ের স্কুলে যাওয়া। একপর্যায়ে তারা বাধ্য হয় বাল্যবিয়ে দিতে। এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দায়িত্বও নিতে হবে রাষ্ট্রকে। বাল্যবিয়ে নিরোধের ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইমামদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সরকারের নির্দেশনা রয়েছে জুমার খুতবার আগে ও ওয়াজ মাহফিলে বাল্যবিয়ে বিষয়ে ধারণা ও ইসলামিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার। শীত মৌসুমে সারা দেশে শত শত ইসলামিক জলসা ও ওয়াজের আয়োজন করা হয়। কিন্তু সেখানে বাল্যবিয়েসহ সচেতনতামূলক বক্তব্য তুলে ধরার খবর আমরা খুব একটা পাই না।
বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকারি হটলাইন নম্বর ৩৩৩-এর ব্যবহারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। আগস্ট মাসে বাল্যবিয়ে-সংক্রান্ত কল এসেছে ১৫০টি। এ ছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ হেল্পলাইনে গত চার বছরে বিভিন্ন সেবা পেতে মোট কল এসেছে সাড়ে ৩ কোটির বেশি। এর মধ্যে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ২০২১ সালে ৪ হাজার ৬৫৮টি কল এসেছে এবং বেশ কিছু বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা হয়েছে। তবে সরকারের হেল্পলাইন নম্বর ১০৯ এবং ৯৯৯-এ সেবা পেতে অনেক ক্ষেত্রেই দায়িত্বপ্রাপ্তরা একে অপরের দিকে দায়িত্ব ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে মত দেন এনজিওকর্মীরা। জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারে ফোন করে বাল্যবিয়ে ঠেকাতে সাহায্য চাওয়া যায়। কিন্তু বিপদগ্রস্ত মানুষের কাছে দ্রুত চলে যাওয়া, তার পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি কাজের জন্য যে জনবলের প্রয়োজন, বাস্তবে সেটা নেই। এ বিষয়ে সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের অঙ্গীকার করেছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করা তারই অংশ। এটি বন্ধে সামাজিকভাবেই ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে কাজে লাগানো উচিত। পাশাপাশি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে প্রচার কার্যক্রমেও ভিন্নতা আনা প্রয়োজন। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের প্রধান লক্ষ্য রেখে প্রচার-প্রচারণাকে ঢেলে সাজানো উচিত বলে মনে করেন অনেকেই। বাল্যবিয়ে রোধ ও বিচার করতে হলে সরকার, বেসরকারি সংগঠন ও পেশাজীবীদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। শুধু সচেতনতাই নয়, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে চাই সম্মিলিত উদ্যোগ।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
© 2022, https:.