কলাম

অধিক মুনাফার লোভে পর্যটনের ক্ষতি

দুর্গাপূজা আর ঈদে মিলাদুন্নবীর সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে এবার প্রায় পাঁচ দিনের বন্ধ ছিল। ফলে ভ্রমণপাগল লাখো মানুষ ছুটে গেছেন পাহাড়, সমুদ্র ও নদীর আলিঙ্গন পেতে। কিন্তু সেখানে তাদের আনন্দ উপভোগে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে হোটেল ও মোটেলের অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারিতা। হোটেল, রিসোর্ট বা গেস্ট হাউজগুলোর ভাড়া কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে পণ্যের ও খাবারের দোকান এবং যানবাহনের চালকরাও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে মেতে উঠেছিলেন। ফলে পর্যটকদের গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। এছাড়া পর্যটকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার অভিযোগও উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। যা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। এতে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভ করলেও পর্যটন শিল্পে এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন অনেকেই।

পাশাপাশি এবার পর্যটন এলাকাগুলোতে প্রশাসনের দুর্বলতাও উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। খাবারসহ হোটেল ও মোটেলের ভাড়া কেন সরকারকর্তৃক নিয়ন্ত্রিত নয়, পর্যটকরা কেন স্বাভাবিক সেবা থেকে বঞ্চিত হলেন? এসব অভিযোগ দেখার জন্য কোন কর্তৃপক্ষ দায়িত্বে আছেন? এমন নানা প্রশ্নও উঠেছে পর্যটকদের মনে। অথচ ২৭ সেপ্টেম্বর ঘটা করে পালিত হলো বিশ্ব পর্যটন দিবস। ‘পর্যটনে নতুন ভাবনা’ প্রতিপাদ্যে দিবসটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, ‘পর্যটন শিল্প বিশ্বে একটি অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ও শ্রমঘন খাত। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য পর্যটন একটি কার্যকর উন্নয়ন কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আসুন, সম্মিলিতভাবে পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশে কাজ করে বিশ্বদরবারে দেশের পর্যটন শিল্পকে কার্যকরভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে জাতির পিতার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলি।’

প্রধানমন্ত্রীর বাণীতেই বাংলাদেশে পর্যটনের সম্ভাবনা ও গুরুত্ব উঠে আসলেও বাস্তবে এ খাতে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ ও নতুন নতুন পর্যটন স্পট তৈরিতে সরকার কীভাবে কাজ করছে সেটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিন, পতেঙ্গা, কক্সবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ ইত্যাদি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য প্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হলেও সেসব জায়গার যোগাযোগ, নিরাপত্তা, খাবার-দাবার নিয়ে পর্যটকদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এসব সমস্যার সমাধান না করলে দেশের পর্যটন কোনোভাবেই এগোবে না বলে মনে করেন অনেকেই।

পর্যটনে আমাদের সম্ভাবনা, উদ্যোগ ও সমস্যার কথা জানাতে এখানে কিছু পর্যটন এলাকার তথ্য তুলে ধরছি :

প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর হাওর-বাঁওড়-নদীবেষ্টিত জেলা কিশোরগঞ্জ। প্রতিদিন হাজারো মানুষের পদভারে মুখর থাকে হাওরাঞ্চল। শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, ধূলিওড়া মেঠোপথও আকর্ষণ করে পর্যটকদের। কিন্তু এ এলাকায় পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের আবাসন, খাওয়া-দাওয়াসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতেই হচ্ছে। হাওরে পর্যটকদের জন্য রাত্রিযাপন, খাওয়া-দাওয়া এবং আনন্দ বিনোদনের সুব্যবস্থা রাখা জরুরি। সেটি করতে হবে পরিবেশ সুরক্ষার দিকটি মাথায় রেখেই। এছাড়া সেখানে নৌকার মাঝিদের সিন্ডিকেট ও অতিরিক্ত নৌকাভাড়া নেওয়ার কারণেও পর্যটক কমছে বলে মনে করেন অনেক পর্যটক।

চলতি মৌসুমে প্রায় অর্ধশতাধিক নতুন হাউজবোট নেমেছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধরমপাশা উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে। যার মালিকানা প্রায় দুই শতাধিক তরুণের। এটিকে সম্ভাবনার চোখে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান সন্তোষ কুমার দেব। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন এভাবে ‘ঠিকমতো ব্র্যান্ডিং করা গেলে হাওর পর্যটনে বাইরের পর্যটকও পাওয়া যাবে। তাই যেসব তরুণ হাওর পর্যটনে এগিয়ে এসেছেন, তাদের সহজ শর্তে ঋণসহ সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।’

আবার সবুজে ঘেরা টিলা আর চমৎকার সব রিসোর্ট রয়েছে চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। একদিকে হাওর, অন্যদিকে চা-বাগান নিয়ে এখানে পর্যটনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন কমছে বলে মনে করেন পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। আর পর্যটকদের ভাষ্য, ট্রেনের পর্যাপ্ত টিকিট না থাকা, ভাঙা রাস্তা, চিত্তবিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা, সেবার তুলনায় হোটেল-রিসোর্টে বেশি খরচের কারণে পর্যটকরা সেখানে যেতে চান না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনার কথা আমরা প্রায়শই শুনি। কিন্তু পাহাড়ে কোন ধরনের পর্যটন সম্ভাবনাকে টেকসই ও লাগসইভাবে কাজে লাগানো যাবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ও পরিকল্পনা নেই সংশ্লিষ্টদের। সেখানে পর্যটন উন্নয়নের নামে যা হচ্ছে, তার সবই অপরিকল্পিত বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। ফলে এই পর্যটন নিয়ে পাহাড়ের আদিবাসীদের মনে বিরূপ ধারণাও তৈরি হয়েছে। পর্যটন মানে পাহাড়ে বহিরাগত লোকজনের ভূমিদখল ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে মনে করে আদিবাসীরা। পর্যটনবিশেষজ্ঞদের মতে, নেতিবাচক এই ধারণা কমিউনিটি ট্যুরিজম (সামাজিক পর্যটন) ও ইকো-ট্যুরিজমের (প্রতিবেশ পর্যটন) মাধ্যমে দূর করা যেতে পারে। এ নিয়ে সচেতনতা ও সমন্বিত উদ্যোগেরও প্রয়োজন।

বাগেরহাটের দক্ষিণে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর। দীর্ঘদিন পর্যটকবান্ধব প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা গড়ে না ওঠায় বাগেরহাটের পর্যটন খাত এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। জেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পুরাকীর্তি ও প্রতœতত্ত্ব। আছে মাছ, চিংড়ি, সবজিসহ কৃষিপণ্যের প্রাচুর্য। আরও রয়েছে জেলে, মৌয়াল, কৃষক ও কারুশিল্পীদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পর্যটন বিকাশের এমন অনুষঙ্গ থাকলেও পিছিয়ে আছে সম্ভাবনাময় এ জেলা। কেন? স্থানীয়রা মনে করেন দর্শনার্থীদের কাছে স্থানগুলোর গুরুত্ব ও সৌন্দর্য সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারা, সরকারি পর্যায় থেকে ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে সমন্বয় ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত না হওয়ার কারণেই এ অঞ্চলের পর্যটনশিল্পের বিকাশ সেভাবে ঘটছে না। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনা।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের শেষ ও বঙ্গোপসাগর তীরের জেলা বরগুনার মতো প্রকৃতির বাহারি সৌন্দর্যের সমাহার খুব কম জায়গায়ই মেলে। শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত, টেংরাগিরি বনাঞ্চল, হরিণঘাটা বনাঞ্চল, মোহনা পর্যটনকেন্দ্রসহ জেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্য। যাকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্প। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ঘিরে দেশের পর্যটনশিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাবে তার বিকাশ ঘটছে না।

এসব পর্যটন স্থানের সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকার আন্তরিক হলে পর্যটনের নতুন নতুন স্পট ও সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে বলে আমরা মনে করি। বিশিষ্টজনেরা মনে করেন, বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলে দেশের অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে। পর্যটন শিল্পের প্রসার করতে টেলিভিশন, বেতার এবং ডিজিটাল মাধ্যমে পর্যটনকেন্দ্র সম্পর্কে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে হবে। সরকারিভাবে একটি ‘ট্যুর ইনফরমেশন সেন্টার’ চালু করা যেতে পারে, যেখান থেকে পর্যটকরা সহজে সব তথ্য পাবেন। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তবে অধিক মুনাফা নয়, পর্যটকদের মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিতের মাধ্যমেই পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন পর্যটকরা। সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৩ অক্টোবর ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button