মুক্তিযুদ্ধ

জনযুদ্ধ ১৯৭১ : অন্তরালের মানুষের গল্প

সময়টা ১৯৭১। একবার নির্দেশ আসে বড়লেখায় সাতমাছড়া সেতু উড়িয়ে দেওয়ার। আমার সঙ্গে ১৩ জন। ক্যাম্প থেকে মুভ করি রাতে।

প্রথম নদীর পারে এসে নৌকা পেলাম। কিন্তু দ্বিতীয় নদীর কাছে কোনো নৌকা ছিল না। রাত তখন ২টা। নৌকার খোঁজে সহযোদ্ধারা আশপাশে ছোটে। কিন্তু না, কোনো নৌকা নেই। কী করব ভাবছি। হঠাৎ আমাদের পেছনে একটি ঝোপে কী যেন নড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক তাক করা হয়। কে ওখানে? কাঁপতে কাঁপতে একটি মেয়ে বেরিয়ে আসে। বয়স তার ১৫ বা ১৬ বছর। পরনে শাড়ি। আঁচলের কিছু অংশ কামড়ে ধরে কাঁপছে। সিলেটি ভাষায় বলে, ‘মুক্তি নি? আমি জানতাম আপনারা আইবা। ’ সে জানাল, গ্রামে মুক্তিবাহিনী আসছে এমন খবর পেলে পাকিস্তানি আর্মি এসে গোটা গ্রামটা জ্বালিয়ে দেবে। সেই ভয়েই গ্রামবাসী ঘাটের সব নৌকা ডুবিয়ে রেখেছে। ‘আও আমার লগে আও’ বলেই মেয়েটি নদীর এক পাশে ডোবানো নৌকাগুলো দেখিয়ে তুলে নিতে বলে। নিজেই খুঁজে আনে লগি। সহযোদ্ধারা পানি সেচে দুটি নৌকা নদীতে ভাসায়। তাকে সঙ্গে নিয়েই ওপারে যাই। একটি নৌকা ঘাটে রাখি। আরেকটি নৌকা নিয়ে মেয়েটি নদীর জলের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। পুরো দৃশ্যটিই স্বপ্নের মতো মনে হয়। সেতুটি উড়িয়ে ভোরের দিকে আমরা ক্যাম্পে ফিরি।

মনের ভেতর এখনো ভেসে ওঠে মেয়েটির মুখখানা। গ্রামবাসীর চোখ এড়িয়ে, জীবনের ঝুঁঁকি জেনেও ওই রাতে সে এসেছিল শুধুই মুক্তিযোদ্ধাদের পার করিয়ে দিতে। এর চেয়ে বড় যুদ্ধ আর কী হতে পারে! সহযোদ্ধাদের কাছে মেয়েটি ছিল পরি বা ফেরেশতা। কিন্তু আমার কাছে সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। ইতিহাসের ভেতরের ইতিহাসটিও তুলে আনতে হবে। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হবে না। একাত্তরে এমন নারী ও সাধারণ মানুষ পাশে ছিল বলেই মাত্র ৯ মাসে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তাই সাধারণ মানুষের এমন অসাধারণ ইতিহাসগুলোও তুলে আনা প্রয়োজন।

একাত্তরের একটি ঘটনা তুলে ধরে এভাবেই নিজের মতামত তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আহম্মদ বাবু। তিনি যুদ্ধ করেছেন ৪ নম্বর সেক্টরে, কুকিতল ক্যাম্পের কমান্ডারও ছিলেন।

কথা হয় একই সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক নূর উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। একাত্তরের একটি অজানা ঘটনার কথা তুলে ধরে এই বীর বলেন, ‘লাঠিটিলা বর্ডারে ছিল পাকিস্তানি আর্মিদের একটি ক্যাম্প, আমাদের ক্যাম্প থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে। ওখানে আক্রমণ চালাতে হবে। রেকি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। গোপনে ওই এলাকায় গিয়ে লোক মারফত নানা তথ্য নিয়ে রেকি করি। এভাবেই ঠিক করা হয় টার্গেট।

রাতে আমরা গন্তব্যে পজিশন নিয়ে ভোরে আক্রমণ করব। মিত্র বাহিনী পেছন থেকে আর্টিলারি সার্পোট দিলে সামনে এগোই। দুই দিক থেকে আক্রমণ চলে। ফলে ওরা টিকতে পারে না। ওই ক্যাম্পে সাতজনের মতো পাকিস্তানি আর্মি মারা যায়। ওরা পাল্টা আক্রমণও চালায়। কিন্তু তার আগেই সফলভাবে ফিরে আসি।

এ সফলতায় বিশাল অবদান ছিল ওই বাঙালি কুলির। পাকিস্তানি আর্মির হাতে অস্ত্র। জীবন যাওয়ার ভয়ও ছিল। তবু তাদের ভুল পথে নিয়ে আসছে। এভাবে সাধারণ মানুষ আমাদের সহযোগিতা করেছে। কোনো অপারেশনের আগে রেকি করার জন্য ওই এলাকার একজন গাইড লাগত, যে ওই এলাকা সম্পর্কে জানে। কোন জায়গায় আর্মি আছে, তারা কোন পথে আসা-যাওয়া করে—এমন তথ্য সে বললে আমরা ম্যাপ করে নিতাম। যখন যুদ্ধ করেছি, তখন ভাবিনি ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হবে। ভাবছি, আমরা মারা যাব। পরবর্তী প্রজন্ম আবার ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধটা এগিয়ে নেবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সহযোগিতার কারণেই গেরিলা যুদ্ধে সফল হই। ’

ঢাকার গেরিলা তৌফিকুর রহমানও তা-ই মনে করেন। তিনি অকপটে বলেন, ‘একটি দেশে গেরিলা তখনই থাকতে পারে, যখন সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়া যায়। জনগণের সমর্থন ছাড়া গেরিলা অপারেশনও হয় না। সেই সমর্থন আমরা শতভাগ পেয়েছিলাম। এ কারণেই একাত্তরের যুদ্ধটি ছিল একটি জনযুদ্ধ, যেটি না বললে কিন্তু ভুল হবে। আমি গেরিলা, পথে আমাকে গ্রামবাসী খাইয়েছে। প্রতিটি ধাপে এরাই আমাদের হেল্প করেছে। ’

উদাহরণ টেনে তিনি আরো বলেন, ‘সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের গাজীবাড়ি গ্রামে স্থানীয় যুবকদের ট্রেনিং করাই। এসএলআরের ওপর প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। শিমুলিয়ার তৎকালীন চেয়ারম্যান আহম্মেদ আলী সব সময় খোঁজ নিতেন কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। কোন বাড়িতে গিয়ে আমরা থাকতে পারব। ঈদে একটু ভালো খেতে পারব। সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। একাত্তরে এমন মানুষদের কন্ট্রিবিউশনও কম ছিল না। ’

আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন চৌধুরী। বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। বিএলএফের অধীনে যুদ্ধ করেছেন ফটিকছড়ির যোগ্যাছোলা, রাঙামাটির কাউখালী, কুতুবদিয়া থানা ও বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায়। একাত্তরে ফটিকছড়ির যোগ্যাছোলায় এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের মর্টারের স্প্লিন্টারে আহত হওয়ার পর ফিরে আসেন ক্যাম্পে। কী দেখলেন এসে? তিনি বলেন, “দেখি খাবার রেডি, গরম গরম ভাত। যুদ্ধের সময়ও এসব নিয়ে এলো কে? স্থানীয় এক মাদরাসার হুজুরের বউ। উনার কেউ নেই। তাঁকে ডেকে সবাই বলে, জীবন বাঁচাতে এলাকার সবাই চলে গেছে, আপনি যাননি কেন? উনি বলেন, ‘বাবা, কোথায় যামু, আমার ছেলেরা যুদ্ধে গেছে, মা হয়ে আমি কি পালায়া যাইতে পারি?’ এ ঘটনা বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন এই মুক্তিযোদ্ধা। ” বলেন, ‘এটাও একটা বড় যুদ্ধ, যা করেছিল সাধারণ মানুষ। একাত্তরে ওই নারীর অবদানও কিন্তু কম ছিল না। ’

আরেকটি ঘটনার কথা তুলে ধরেন এভাবে—‘রাঙামাটি এলাকায় এক বুড়ির বাড়িতে আমরা উঠি। উনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই বাড়িতে পানি রাখতেন। শীতের দিন। আমার প্রচণ্ড জ্বর ছিল। জোর করে ওই বুড়ি একটি কাঁথা দিয়ে দেন। নিতে চাই না প্রথম। নেওয়ার নিয়মও নেই। কিন্তু বুড়িটি আধাকিলোমিটার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে কাঁথাটি শরীরে জড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনিও তো একজন মুক্তিযোদ্ধা। ওটাও তো দেশপ্রেম ছিল। কিন্তু ইতিহাসে কি ওই বুড়ির নাম লেখা হয়েছে?’

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পুরোপুরি একটি জনযুদ্ধ। তৃণমূলের মানুষের লড়াই ছিল সেটি। সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সবাইকে এক করেছিলেন তিনি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৫১ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সাধারণ মানুষ বা জনযোদ্ধাদের ইতিহাস উঠে আসেনি তেমন। লেখা হয়নি কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থও, যার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, আপনার, আমার, সবারই।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকণ্ঠেরে বিজয় দিবস ২০২২ সংখ্যায়, প্রকাশকাল: ১৬ ডিসেম্বর ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button