গণমাধ্যমে জাগ্রত থাকুক মুক্তিযুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণাকাজের সূত্রে কথা হচ্ছিল ঢাকার গেরিলা তৌফিকুর রহমানের সঙ্গে। তার নেতৃত্বেই একাত্তরে কাকরাইল পেট্রল পাম্প উড়িয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদান কতটুকু ছিল? এমন প্রশ্নে তিনি বলছিলেন‘একটা দেশে গেরিলা তখনই থাকতে পারে যখন সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়া যায়। জনগণের সমর্থন ছাড়া গেরিলা অপারেশনও হয় না। সেই সমর্থন আমরা শতভাগ পেয়েছিলাম। এ কারণেই একাত্তরের যুদ্ধটা ছিল একটি জনযুদ্ধ। যেটা না বললে কিন্তু ভুল হবে। আমি গেরিলা। একা যুদ্ধ করিনি। পথে পথে আমাকে গ্রামবাসী খাইয়েছে। প্রতিটি ধাপে এরাই আমাদের হেল্প করেছে।’
উদাহরণ টেনে তিনি আরও বলেন, ‘একাত্তরে সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের গাজীবাড়ি গ্রামে স্থানীয় যুবকদের ট্রেনিং করাই। এসএলআরের ওপর প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। সহযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম স্বপনের তোলা ওই সময়কার একটা ছবি এখনো আছে। ওখানে আহম্মেদ আলী চেয়ারম্যান সব সময় খোঁজ নিতেন কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। বলতেন কোন বাড়িতে গিয়ে আমরা থাকতে পারব। ঈদে একটু ভালো খেতে পারব। সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। একাত্তরে এমন মানুষদের কন্ট্রিবিউশনও কম ছিল না। কিন্তু কই তাদের কথা তো আমরা তুলে ধরি না।’
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদান প্রসঙ্গে কথা হয় ছয় নম্বর সেক্টরের চিলাহাটি সাব-সেক্টরের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশীদের সঙ্গেও। মুক্তিযুদ্ধকালীন এই সাব-সেক্টরের দায়িত্ব ছিল ডিমলা ও নীলফামারী অঞ্চলের সৈয়দপুর, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী, জলঢাকা, ডোমার, ডিমলা প্রভৃতি এলাকা।
তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের সহযোগিতার কথা আমরা ভুলে গেছি। তার ভাষায়, ‘এই নয় মাসে যারা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন, তাদের কথাই কেউ বলি না। পাকিস্তানি সেনারা অ্যাটাক করলে আমরা যারা সৈনিক বা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম তারা ইন্ডিয়াতে সরে যেতে পারতাম। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা গ্রাম বা শহরে ছিলেন তারা কোথায় যাবে? তারাই সরাসরি ওদের অত্যাচার ফেইস করেছেন। গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আসছে এই অপরাধে গ্রামের বাড়িগুলো ওরা জ্বালিয়ে দিত। এভাবে নির্যাতিত হয়েছেন সাধারণ মানুষ।’
‘চিলাহাটি থেকে যখন দুটো কোম্পানি নিয়ে মার্চ করি, রাস্তায় দেখি শত শত লোক মুড়ি আর গুড় হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেক জায়গায় অচেনা লোকরাই রান্না করে খাবার দিয়েছেন। এটা যে কত বড় সাপোর্ট আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন ও অ্যামুনেশান ক্যারি করার জন্য লোক লাগত। গ্রামের মানুষই ভলান্টিয়ার করেছে। সৈয়দপুরে ধরে ধরে বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, রংপুরের অনেককেই মেরে ফেলা হয়েছে, বুড়িমারীতে রেপ করে মেরে ফেলা হয় বহু নারীকে। কই তাদের কথা তো আমরা তুলে আনিনি।’
আক্ষেপের সুরে তিনি আরও বলছিলেন, “পাকিস্তানি আর্মিরা কোথায় লুকিয়ে আছে তা আগেই এসে আমাদের বলে যেতেন সাধারণ মানুষ। কারণ তারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন। পাকিস্তানি আর্মিই বলেছি ‘যেদিকে দেখি সেদিকেই শত্রু দেখি। উই ক্যান নট ট্রাস্ট আ সিঙ্গেল বেঙ্গলি।’ তারা তো কোনো অংশেই কম ছিলেন না। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের সঙ্গে ছিলেন না। বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল এটা। তাই একাত্তরে সবচেয়ে বড় কন্ট্রিবিউশন ছিল সাধারণ মানুষের। উই মাস্ট স্যালুট দেম। কিন্তু স্বাধীনতার একান্ন বছর শেষ হলো। উই ডোন্ট স্যালুট দ্য পিপল।”
এ দুই মুক্তিযোদ্ধাই অভিমত প্রকাশ এবং অনুরোধ জানান একাত্তরে তৃণমূলে সাধারণ মানুষের ইতিহাসও তুলে আনার। আবার মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের ইতিহাস, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের ইতিহাস ও লাখো শহীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস শুধু তুলে আনলেই হবে না সেসব প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাও আবশ্যক। আর সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে দায়িত্ব কি পালন করছে গণমাধ্যমগুলো?
বর্তমান সময়ে টিভি চ্যানেলগুলোতে দেশের গান, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, মুক্তিযোদ্ধাদের কাহিনী, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র, নাটক প্রভৃতি দেখলেই বোঝা যায় মাসটা ডিসেম্বর, নয়তো মার্চ। একইভাবে পত্রিকায় যখন প্রথম পাতায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ধারাবাহিক লেখা স্থান পায়, তখনই বুঝতে হয় মাসটি মুক্তিযুদ্ধের। গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এভাবেই দেখছে এ প্রজন্ম। ফলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তরুণ প্রজন্মের মাসভিত্তিক ধারণা হওয়াটাও খুব সুখকর বিষয় নয়।
গণমাধ্যম গণমানুষের ভাবনার জগতে নাড়া দেয়। সেখানে যা প্রকাশ পায় মানুষ সে বিষয়ে চিন্তা করে। সহজভাবে বলতে গেলে, গণমাধ্যম মানুষের চিন্তার জগৎকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। এক অর্থে গণমাধ্যম, যা ভাবায় মানুষ তাই ভাবে। সে হিসেবে প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনন্য। কিন্তু সেই গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ থাকে মাত্র দুই মাস। ব্যতিক্রম থাকলেও তার সংখ্যা খুবই নগণ্য। বাস্তবে গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টিকে আমরা পাই আর সব দিবসের মতোই একটি ইভেন্ট হিসেবে, যা মোটেই প্রত্যাশিত নয়।
টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনুষ্ঠান সারা বছরই হতে পারে। কিন্তু তা আমরা পাই না। প্রায় প্রতিটি চ্যানেলে অপরাধবিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় নিয়মিতভাবে, সারা বছর। সেটি যদি নিয়মিত হতে পারে, তবে কেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনুষ্ঠান নিয়মিত নয়! ছাপা পত্রিকাগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র বা বিশেষ সংখ্যা বের করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি। ডিসেম্বর ও মার্চে সারা দেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপন ও বাণী ছাপানোর হিড়িকও পড়ে যায়। বিশেষ দিবসে বিশেষ সংখ্যা হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সারা বছর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে গণমাধ্যমে শুধু দুই মাসের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ রাখা কাক্সিক্ষত নয়।
দৈনিক পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি কর্নার, চ্যানেলগুলোতে একটি করে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান, অনলাইনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা তথ্যের উপস্থাপনায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে খুব সহজেই। আর এটা করা গেলে মানুষের ভাবনার মধ্যে যুক্ত হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সংগ্রামের ও আমাদের বীরত্বের কাহিনীগুলো, যা জেনে পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হবে।
আবার চ্যানেলগুলোতে টকশোর বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের কোনো একটি বিষয়কে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় আমরা দেখি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত কোনো বিষয় নিয়ে টকশোজীবীরা আলোচনা করতে গিয়ে এমন সব অবাস্তব তথ্য ও বিষয়ের কথা তুলে ধরেন, যার কোনোই ভিত্তি নেই। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রকৃত সত্য নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। তাই মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের ইতিহাস প্রকাশে গণমাধ্যমকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের কথা তুলে আনা যেমন জরুরি পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা এই তিনটি বিষয়কে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রজন্ম গড়তে আমরা চাই, গণমাধ্যমে সদা জাগ্রত থাকুক মুক্তিযুদ্ধ।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৭ জানুয়ারি ২০২২
© 2023, https:.